শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠের নম্র মানুষ

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠের নম্র মানুষ

কদিন আগে শুরু হয়েছে আগস্ট মাস। শোকের মাস। অন্য এক বিষণ্নতায় আক্রান্ত হই এ আগস্টে। কত কিছু মনে হয়। কত কিছু লিখতে ইচ্ছে হয়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। বিচারিক কর্মের বাইরে অবসরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গ্রন্থাদি পড়ে আরও আরও জানতে চেষ্টা করি বঙ্গবন্ধুর কর্ম, দর্শন ও ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য। আজ এ শোকের মাসে শ্রদ্ধাবনত ও বিনম্রচিত্তে বজ্রকণ্ঠের সাহসী মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর কিছু ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলছি।

আমরা জানি, নানা ধ্যান-ধারণা ও দর্শনপুষ্ট মানুষ সব সমাজেই রয়েছে। আমাদের সমাজেও অনেক ধরনের মানুষ দেখা যায়। বদমেজাজ, গম্ভীর স্বভাব, প্রাণখোলা চরিত্র-মূলত এসবই আমাদের সমাজে অনেক ধরনের মানুষের মাঝে দৃশ্যমান। আমাদের সমাজে এক ধরনের কথা প্রচলিত আছে যে, ‘তিনি একজন ভদ্রলোক কিন্তু খুব রাগী, সৎ মানুষ তো তাই।’ এ কথার অর্থ কি এটিই যে, একজন মানুষ সৎ ও নৈতিক হলেই তাকে গুমরো মুখো হতে হবে বা বদরাগী হতে হবে বা গম্ভীর স্বভাবের হতে হবে। সদালাপী, প্রাণখোলা একজন মানুষ কি সৎ ও নৈতিক হতে পারে না। একজন সৎ ও নৈতিক মানুষ কি বিনয়ী বা ভদ্র স্বভাবের হন না। আসলে ব্যাপারটি এরকম নয়। সাহস ও সততার সঙ্গে ভদ্র ও নম্র স্বভাবের মিলন হতেই পারে। পৃথিবীর প্রায় সব মহামানবের মাঝেই ছিল এ দুটো বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ। মানব জাতির দিকনির্দেশনার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রেরিত ইসলাম ধর্মের নবী, রসুল বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অবতারদের মধ্যেও এ গুণটি পরিলক্ষিত হয়।

স্রষ্টার সৃষ্টি একজন মানুষ নিজ চেষ্টায় অনুশীলনে নম্র ও ভদ্র হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে। কিন্তু তারপরও নম্রতা ভদ্রতা মহান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি বিশেষ গুণ। কারণ অনেকেই এ গুণ অর্জনে সক্ষম হয় না। আমার বিশ্বাস কর্মে ও কথায় এর অনুশীলন হয়ে থাকে। সেই কর্ম ও কথা হতে হবে মানবিক ও মানব কল্যাণমুখী। আর এ গুণটি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মে, কথায়, আদর্শে, দর্শনে।

আমি ইতিপূর্বে প্রকাশিত আমার কিছু লেখায় উল্লেখ করেছি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বিশ¡কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে কোনো কিছু বলতে বা লিখতে গেলে আমার খুব ভয় হয়। পাছে কোনো ভুল করে ফেলি কিনা। কেননা এ দুই মহান বাঙালি সম্পর্কে বাঙালিরা বা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এত বেশি আলোচনা, গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন যে-এঁদের সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলেই আমার শুধু মনে হয়, আমি Plagiarism বা লেখা চুরির দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ছি কিনা। তারপরও আমি চেষ্টা করি এঁদের জীবন দর্শন ও কর্ম সম্ভারে ঘুরে নিজের অর্জিত ভাবনাকে প্রকাশ করতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তো আমার দেখার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জাতির জনক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। আমার শৈশবে তাঁকে সেই দেখার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর মতো হিমালয়তুল্য একজন মানুষকে মূল্যায়ন করা তো আর সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন লেখকের লেখায় নিবিষ্ট হয়ে তাঁর সম্বন্ধে আমার মনোজগতে সৃষ্ট আমার ভাবনাটিই প্রকাশ করতে পারি মাত্র।

মনে পড়ে, ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধুকে আমার প্রথম স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়। পৈতৃক আবাসস্থল মোহনগঞ্জের লোহিয়ার মাঠে জনাব আবদুল মমিন ও আমার বাবা ডা. আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদের এক নির্বাচনী সভায়। দীর্ঘদেহী সৌম্য দর্শন বঙ্গবন্ধুকে ওই বালক বয়সে দেখে আমার মনে হয়েছিল আমাদের নেতা তো চেহারা ছবিতে আইয়ুব খান বা ইয়াহিয়া খানের চেয়ে কম নন। ওই রকম লম্বা সুদর্শন বাঙালি পুরুষ আমাদের সমাজে আসলেও খুব একটা দেখা যায় না। সেদিনের পর শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয়বার দেখি ১৯৭২ সালে। নাখালপাড়ার সংসদ ভবনে।

৭ মার্চ, ১৯৭১ সালে তাঁকে অন্তর আত্মা দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি যেভাবে দেখতে পেয়েছিল আমিও রেডিওতে তাঁর বজ্রকণ্ঠের সেই ভাষণ শুনে খুবই উদ্বেলিত হই। রাজনীতির কবির সেদিনের সেই ভাষণ শুনে আনন্দ অনুভব করছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তার জবাব ইয়াহিয়া খান দিতে পারবে না। বালক বয়সেই ওই ভাষণ ও ভাষণে উচ্চারিত সাহসী বচনগুলো আমার মনে এক ধরনের বীরত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করে। যদিও রাজনীতির অনেক কিছুই তখন  বুঝতাম না। ততদিনে আমার বাবা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে রাজনৈতিকভাবে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন। আমার বাবা তখন নিয়তই ঢাকায় কি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু কি নির্দেশ দিচ্ছেন এসব আলোচনা করতেন বাসায় কর্মীদের নিয়ে। কর্মীদের দিতেন নির্দেশনা। তখন সেই পরিবেশে আমি আমার ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে এসব নিয়ে অনেক কথা বলতাম। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দর্শন, আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য জানার আগ্রহ তখন থেকেই।

যা হোক, যে কথাগুলো আজ এই পরিণত বয়সে বলতে চাই তা হলো বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন সাহসী, আপসহীন, সংগ্রামী পুরুষ ঠিক তেমনি তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক এবং বিনয়ী ও মানবিক স্বভাবের মানুষ। ৭ মার্চের পটভূমি আমরা বাঙালিরা সবাই আজ কমবেশি জানি। ওই রকম একটি বৈরী ও বৈষম্যমূলক পরিবেশের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি কোনোরূপ অবজ্ঞার সুরে কথা বলেননি। যদিও তাঁর প্রতিটি কথায় ছিল দৃঢ়তা। বাঙালির অধিকার নিশ্চিতে অনড় প্রতিজ্ঞা।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতায় ইয়াহিয়া খান সম্বন্ধে বলেছেন-‘১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সাথে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাঁকে অনুরোধ করলাম, ১৫ ফেব্র“য়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ ওই বক্তৃতায় জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেছেন-‘ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করলাম আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ-আলোচনা করে শাসনতন্ত্র তৈরি করব।’

ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে আরও বলেছিলেন-‘টেলিফোনে আমার সাথে তাঁর (ইয়াহিয়া খানের) কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপর আমার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’

ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো উভয়েই বাঙালির বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন এ কথা বঙ্গবন্ধু সম্যক উপলব্ধি করার পরও বক্তৃতার সময় তাদের প্রতি একটিও অশালীন শব্দ বা অবজ্ঞাসূচক শব্দ উচ্চারণ করেননি। যদি তিনি তা করতেনও জনগণ তা স্বাভাবিকভাবেই নিত। কিন্তু শত উত্তেজনার মধ্যেও উত্তাল জনসমুদ্রের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু Temper lose করেননি। এমন বিরল গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য কেবল পৃথিবীর বড় মাপের মানুষদের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশে¡র বড় মাপের মানুষদের একজন। বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত তাঁর রাজনীতি ও দর্শন। সেজন্যই এ ধরনের গুণাবলি তাঁর মধ্যে ছিল। যার স্বীকৃতি হিসাবে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন- ‘I haven’t seen Himalayas but have seen Sheikh Mujib. In personality and in courage, this man is the Himalayas. I have thus had the experience of witnessing the Himalayas.’

Personality শব্দটির অর্থ একটু ব্যাপক। কোনো কোনো অভিধানে  personality কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে-‘It’s a characteristic sets of behaviors’, cognitions and emotional patterns that evolve from biological and environmental factors.’ বাংলায় বলা যায়, এটি এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা ধীশক্তি ও চারিত্রিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষের উৎকৃষ্ট উদাহরণ যা সেই মানুষটি জন্মগতভাবে অর্থাৎ পরিবার থেকে ও যে পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে সেখান থেকেও পেয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মন্তব্যটি শুধু বঙ্গবন্ধুকেই মহিমানি¡ত করেনি, ওই মন্তব্যটি  অনিবার্যভাবে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে বাঙালি জাতিকে ও বাংলাদেশকে যে দেশটির স্বপ্নদ্রষ্টা ও জাতির জনক ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর ওপর লিখিত অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার পঠিত অনেক বইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অন্যতম। এ বইটি বাংলাদেশে বহুল পঠিত বইয়ের একটি। বইটি লেখার শুরুতে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যটি এভাবে বিবৃত হয়েছে-“বন্ধুবান্ধবরা বলে, ‘তোমার জীবনী লেখ।’ সহকর্মীরা বলে, ‘রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’ আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ বললাম, ‘লিখতে যে পারি না, আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”

এই বইতে পাকিস্তানের অনেক নেতৃবৃন্দের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম প্রমুখের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কাজ করেছেন। তাঁদের নীতি আদর্শের সঙ্গে তখনকার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু অনেক সময়ই সহমত পোষণ করেছেন। তাঁদের তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন বলে বইটির বহু জায়গায় উল্লেখিত আছে। কিন্তু যে বিষয়টি লক্ষণীয় সেটি হলো যাঁদের সঙ্গে তাঁর আদর্শগত মিল ছিল না যেমন, খাজা নাজিমুদ্দিন, খাজা শাহাবুদ্দিন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, বগুড়ার ফজলুল বারী, খুলনার সবুর খাঁন তাঁদের সম্বন্ধেও লিখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সম¥ানের সঙ্গে তাঁদের নাম উচ্চারণ করেছেন। এঁদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের কোনো মিল ছিল না। কিন্তু তারপরও ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ ছিল না। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে বঙ্গবন্ধু কখনো কার্পণ্য করেছেন এ কথা তাঁর শত্র“রাও বলবে না। এটি বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক শিক্ষা। তাঁর ধৈর্যশীল পিতা শেখ লুৎফর রহমানের 

শিক্ষা। ড. সুনীল কান্তি দে কর্তৃক সম্পাদিত বই ‘বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র’-এর ২২৭ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর মরহুম পিতা শেখ লুৎফর রহমানের ৩১ মার্চ ১৯৬২-এর চিঠিটি পড়ে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর পিতার কাছ থেকে কী ধরনের ধৈর্যের তালিম পেয়েছেন এবং সেটির চর্চায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাবা লিখছেন-

“বাবা খোকা,

শুরুতেই দোয়া জানিবা। তোমাকে আটক করিয়া রাখার অর্থ হইতেছে আমাদের মতন বৃদ্ধ পিতা মাতা, ও নাবালক ছেলে মেয়েদের এবং স্ত্রীর উপর নানারূপ অত্যাচার করা। আমরা উপায়হীন সহ্য করিতে বাধ্য কিন্তু খোদাতায়ালা নিশ্চয়ই সহ্য করিবেন না। চিন্তা করিবা না, সব কিছু খোদাতায়ালার উপর নির্ভর। তিনি যাহা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। সত্যের জয় হইবেই। সব সময় দোয়া করিতেছি এবং খোদার দরগায় প্রার্থনা যে তিনি যেন তোমাদের মঙ্গল করুক। ৮০ বৎসর বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এমন লেখা খুব কঠিন। তাই খুব ধীরে লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরী হয়।

তোমার

আব্বা।”

চিঠিটি পড়ে বোঝা যায়, একজন অশীতিপর বৃদ্ধ পিতা তাঁর সন্তানের ন্যায্য আন্দোলনের প্রতি কীভাবে দৃঢ় সমর্থন দিয়ে গেছেন এবং তাঁর প্রিয় খোকাকে ধৈর্য ধারণ করার কি শিক্ষাই না দিয়েছেন! পিতার আদর্শ ও শিক্ষায় শিক্ষিত ধৈর্যশক্তিতে বলীয়ান বঙ্গবন্ধু তাঁর কর্মী ও সহকর্মীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। তৎকালীন ছাত্রনেতা ময়মনসিংহের জনাব খালেক নেওয়াজ খান যখন জেলে তখন ৬ জুলাই ১৯৫২-তে বঙ্গবন্ধু খালেক নেওয়াজ খান সাহেবের মাকে ‘আম¥া’ সম্বোধন করে নিম্নে উল্লিখিত চিঠিটি লিখেছিলেন-

“আম¥া,

আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম নিবেন। আপনি আমায় জানেন না তবুও আজ লিখতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার ছেলে খালেক নেওয়াজ আজ জেলখানায়। এতে দুঃখ করার কারণ নাই। আমিও দীর্ঘ আড়াই বৎসর কারাগারে কাটাতে বাধ্য হয়েছি। দেশের ও জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্যই সে আজ জেলখানায়। দুঃখ না করে গৌরব করাই আপনার কর্তব্য। যদি কোন কিছুর দরকার হয়, তবে আমায় জানাতে ভুলবেন না। আমি আপনার ছেলের মত। খালেক নেওয়াজ ভাল আছে। জেলখানা থেকেই পরীক্ষা দিচ্ছে। সে মওলানা ভাসানী সাহেবের সাথে আছে।

আপনার স্নেহের

(ং/ফ) শেখ মুজিবুর রহমান”

খালেক নেওয়াজ খানের মাকে ‘আম¥া’ সম্বোধন করে লেখা এই চিঠি থেকে এটি প্রতিফলিত হয় যে, কি মাত্রার সংবেদনশীল মানসিকতার মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সহকর্মীর মাকে নিজের মায়ের স্থানে এনে বঙ্গবন্ধু এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সিংহহৃদয়ের মানুষ না হলে সহকর্মীর মাকে মাতৃজ্ঞান করা সম্ভব নয়। আর বঙ্গবন্ধুকে সিংহহৃদয়বান, সহানুভূতিশীল মায়া মমত্ববোধসম্পন্ন বিনয়ী অথচ দৃঢ়চেতা হয়ে ওঠার শিক্ষাটা দিয়েছিলেন তাঁর পিতা ও মাতা। মূলত পরিবার থেকেই তিনি এ শিক্ষা পেয়েছিলেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ১৭৯ পৃষ্ঠার ২৪ জুলাই ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর লেখা ডাইরির পাতা থেকে উদ্ধৃত কিছু অংশ তুলে ধরছি, যেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর পিতার বৈশিষ্ট্য ও ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন- “আমার বাবা খুব শান্ত প্রকৃতির লোক। সকল সময়ই গাম্ভীর্য নিয়ে থাকেন। তাঁকে আমরা ভাইবোনরা ছোট্টকালে ভালবাসতাম এবং ভয়ও পেতাম। আমার মা আমাদের না দেখলেই কাঁদতেন। তাঁর মধ্যে আবেগ খুব বেশি। কিন্তু আমার বাবার সহ্যশক্তি অসম্ভব। জীবনে মুখ কালো করতে আমি দেখি নাই। বোধ হয় একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম বলে বাবা আমাকেই খুব বেশি স্নেহ করতেন। আব্বা এক জায়গায় লিখেছেন, তোমার গত ১৯/৬/৬৬ এবং ১/৭/৬৬ তারিখের চিঠি দুইখানা গতকাল পাইয়া তোমার কুশল জানিতে পারলাম। তবে আমাদের জন্য যে সব সময় চিন্তিত থাক তাহাও বেশ বুঝিলাম। কখনো আমাদের জন্য চিন্তা করিবা না, খোদার মর্জিতে আমাদের মতন সুখী লোক বোধহয় নাই, থাকিলেও খুব কম। আমার সহ্য শক্তিও আছে, বিপদে আপদে কখনও বিচলিত হই না, তাহা তোমার ভালভাবে জানা আছে।”

বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন- “বারবার আমার আব্বা ও মার কথা মনে পড়তে থাকে। মায়ের সাথে কি আবার দেখা হবে? অনেকক্ষণ খবরের কাগজ ও বই নিয়ে থাকলাম কিন্তু মন থেকে কিছুই মুছতে পারি না, ভালও লাগছে না। অনেকক্ষণ ফুলের বাগানের কাজ করেছি আজ। মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলি স¥রণ করে একটু শান্তি পেলাম।

বিপদে মোরে রক্ষা করো

এ নহে মোর প্রার্থনা,

বিপদে আমি না যেন করি ভয়।”

পরম সহিষ্ণু পিতার ধৈর্যশীল বিনয়ী ও সাহসী সন্তান ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। আমাদের অনেকের ধৈর্য আছে কিন্তু সাহস নেই। আবার আমরা কেউ  বিনয়ী কিন্তু ধৈর্য বা সাহস কোনোটাই নেই। অনেকে আবার সাহসী কিন্তু তার মধ্যে ধৈর্য বা বিনয়ের অভাব দৃশ্যমান। ধৈর্য, বিনয় ও সাহসের সংমিশ্রণ যার মধ্যে আছে সাধারণত সেই মানুষটিই সততা ও মানবিকতার পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ধৈর্য, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা ও সাহসের সংমিশ্রণ ছিল বলেই তিনি একজন সৎ মানুষের প্রতিভূ। পর্বততুল্য ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।

কবি নির্মলেন্দু গুণের বই ‘মুজিব সমগ্র’তে বঙ্গবন্ধুর সততা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ আছে (পৃষ্ঠা-৫৪), যেখানে তিনি লিখেছেন- “আমি মৌলানা শেখ আব্দুল হালিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে তো আপনি খুব ছোটবেলা থেকে দেখেছেন। জেনেছেন। তাঁর সম্পর্কে এমন কোনো ঘটনার কথা কি আপনি আমাকে বলবেন, যে ঘটনাটি আপনার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল, তাঁর সম্পর্কে ভাবতে গেলে যে ঘটনাটির কথা আপনার খুব মনে পড়ে? যে ঘটনাটি আপনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না?”

মৌলানা হালিম আমার প্রশ্নটি গভীর মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। মনে হলো তিনি স্মৃতির সমুদ্রে ডুব দিয়েছেন। আমি চুপ করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তাঁর কপালে চিন্তার বলিরেখা। ঠোঁট দুটি কাঁপছে তাঁর। তিনি চোখ মেললেন। আধো আলো আধো অন্ধকারে আমি লক্ষ্য করলাম- তাঁর চোখের পাতায় অশ্র“ জমেছে। তাঁকে সহজ হতে সাহায্য করে আমি বললাম, কিছু কি মনে পড়ল? আপনার চোখে জল কেন?

তিনি বললেন, একটা ঘটনার কথা আমার খুব মনে পড়ে, আর সেই ঘটনাটির কথা মনে পড়লেই আমার কষ্ট হয়, আমার চোখে পানি এসে যায়। আমি তাঁর মুখ থেকে ওই ঘটনাটি শুনবার জন্য কিছুটা উত্তেজনা বোধ করি। বলি, বলুন শুনি ওই ঘটনাটির কথা। আমার বিশ্বাস ওই ঘটনটির কথা, যা আপনি গোপনে বয়ে চলেছেন আপনার বুকের ভিতরে, সেই ঘটনাটির কথা আমার কাছে প্রকাশ করলে আপনার বুকটা হালকা হবে।

তিনি একটু হাসলেন আমার কথা শুনে। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বললেন আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে আমি একটা কষ্ট দিয়েছি। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই এরকম একটা অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে চলেছে। আমার কেবলই মনে হয়, আমার এই কাজটা করা ঠিক হয়নি।

আমি বললাম, এমন কি কষ্ট আপনি দিয়েছেন তাঁকে, যার জন্য আপনি এখন কষ্ট পাচ্ছেন?

তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু খুব জাঁকজমক করে তাঁর চল্লিশার (চেহলাম) আয়োজন করেছিলেন। আমাকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর পিতার মঙ্গল কামনা করে কোরআন খতমে অংশ নেওয়ার জন্য।

আমি তাঁকে বললাম, তুমি প্রচুর অর্থ খরচ করে তোমার পিতার জন্য যে বিশাল আয়োজন করেছ- এত অর্থ তুমি কীভাবে উপার্জন করেছ, এই নিয়ে আমার মনের মধ্যে কিছু সংশয় তৈরি হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু আমার কথা শুনে একটু ব্যথিত হন। আমি ভেবেছিলাম, তিনি জাতির পিতা, দেশের প্রেসিডেন্ট, তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী- আমার ওপর রাগ হতে পারেন। কিন্তু না। আমার কথা শুনে তিনি একটুও রাগ হলেন না, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হালিম, সত্য কথা বলার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি প্রকৃত ইমানদার মুসলমান।

অন্য কোনো মৌলানা তোমার মতো সাহস করে আমার কাছে তাদের মনে সংশয় থাকলেও তা প্রকাশ করবে না। তোমার সৎসাহস আছে, তাই তুমি করেছ। মনে সংশয় নিয়া তুমি যদি আমার পিতার মঙ্গল কামনা করে কোরআন শরিফ পড়তা, তাতে আল্লাহ নারাজ হতেন। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ। আমার প্রিয় পিতার আখিরাতের মঙ্গলের জন্য আমি নিজেই কোরআন শরিফ পড়ব। তুমি আশপাশে থাইক, কোথাও কোনো ভুল হইলে আমারে বইল।

আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, বঙ্গবন্ধু নির্ভুলভাবে, পবিত্র মনে সেদিন কোরআন শরিফ পাঠ করেছিলেন। ঘটনাটির কথা বলার সময় মৌলানা শেখ আবদুল হালিমের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।

আমি বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর আর্থিক সততা নিয়ে মনে সন্দেহ পোষণ করাটা আমার উচিত হয়নি। আমি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তাঁর মনে একটা খুব বড় রকমের কষ্ট দিয়েছি। সেই জন্য কাঁদছি।

তাঁকে কবর দিয়ে ঘরে ফেরার পর থেকে আমি যখনই তাঁর কথা ভাবি, যখনই আমি তাঁর পিতা, মাতা এবং বঙ্গবন্ধুর কবরের কাছে যাই, পাশ দিয়ে হাঁটি তখনই ওই ঘটনাটার কথা আমার মনে পড়ে যায়। আমার বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। বঙ্গবন্ধুর আর্থিক সততা ও সঙ্গতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার জন্য আমি পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে মাফ চাই।

মৌলানা আবদুল হালিম সম্ভবত এখন বেঁচে নেই। কারণ বঙ্গবন্ধুকে যিনি তুমি সম্বোধন করেছিলেন সম্ভবত তিনি বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী হবেন। বেঁচে থাকেলও তিনি আজ শতবর্ষী। এই মৌলানা শেখ আবদুল হালিমই বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়িয়েছিলেন। মৌলানা সাহেবের সঙ্গে কবি নির্মলেন্দু গুণের কথোপকথন থেকে যা আমরা জানলাম তাতে আবারও আমার বলতে ইচ্ছা করছে মহান হৃদয়বান মানুষ বঙ্গবন্ধুর কাছে মৌলানা হালিম সাহেবের মতো একজন মৌলানা সাহেবেরও যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। তাঁর নিকট থেকে বঙ্গবন্ধু পরামর্শ নিয়ে নিজেই পবিত্র কোরআন শরিফ পাঠ করেছেন বাবার বিদেহী আত্মার মাগফিরাতের জন্য। কোরআন শরিফ পাঠে নিজের ভুল হতে পারে এ সম্ভাবনাও বঙ্গবন্ধু উড়িয়ে দেননি। তাই মৌলানা সাহেবকে কোরআন শরিফ পাঠের সময় তাঁর পাশে থাকতে বলেছেন ভুলত্র“টি হলে যেন মৌলানা সাহেব তাঁকে শুধরে দেন।

অসাধারণ এক নম্র স্বভাবের দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সত্যিই ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ভাষায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিমালয়ের প্রতিভূ। নিজ চিন্তাভাবনায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল। অসীম সাহসের অধিকারী অথচ হিমালয়ের মতো বড় হৃদয়, নম্রতা আর ভদ্রতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণে এক মহান নেতাকে মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের মাতৃভূমির স্থপতি ও জাতির পথপ্রদর্শক নেতা বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন, বাঙালির মুক্তির জন্য। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর শোকের আগস্ট মাসে তাঁর প্রতি আমার গভীর ও বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। প্রত্যাশা করছি যেন বাংলাদেশের প্রত্যেক পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো জানতে, অনুধাবন, ধারণ বা রপ্ত করার শিক্ষা দেন।

আমরা আজ যারা বিচারিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি তাদের উদ্দেশে বলব বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন বলেই আজ আমরা উচ্চতর আদালতে বিচারকের অতি উঁচু আসনে আসীন। যে দুঃখী মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন দিয়ে গেছেন আসুন আমরা সেই নিপীড়িত মানুষের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তথা দেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমি¥লিত ও নির্মোহভাবে কাজ করি। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে।  

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি।

 

সর্বশেষ খবর