রবিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু-অফুরান প্রাণের উৎস

ড. আতিউর রহমান

বঙ্গবন্ধু-অফুরান প্রাণের উৎস

“ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো

দুলতে থাকে স্বাধীনতা,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে

মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।”

কবি শামসুর রাহমানের এই পুরুষ এক ‘দিঘল পুরুষ’। কবির ভাষায় তাঁর ‘নামের ওপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া।’ তিনি আরও লিখেছেন ‘যাঁর নামের ওপর পাখা মেলে দেয়/জ্যোৎস্নার সারস’। কেননা তিনিই যে বাংলাদেশের আরেক নাম। আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। তিনি বাঙালি জাতির পিতা। মানুষ ভালোবেসে তাঁকে জনউপাধি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এই নাম এখন সর্বদাই ‘স্বতোৎসারিত’। তিনি বঁচে আছেন আমাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। তিনি চিরকালই বেঁচে থাকবেন ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ হিসেবেই। কবি মহাদেব সাহার কথাই ঠিক। ‘লিখি বা না লিখি শেখ মুজিব বাংলা ভাষায় প্রতিটি নতুন কবিতা।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘মুজিব গোলাপ হয়ে ফোটে, লাল পদ্ম হয়ে ফোটে হৃদয়ে হৃদয়ে।’  কেউ চাইলেই কি সেই হৃদয়কে অস্বীকারের উপায় আছে? তিনি যে রয়েছেন সর্বত্র।

 

কেননা তিনি যে আমাদের অস্তিত্বেরই অংশ।

তিনি তাঁর নান্দনিক নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও উন্নয়নের সংগ্রামে ভরসার ছায়া হয়ে আছেন। সংগ্রামী এই রাজনৈতিক শিল্পীর ক্যানভাসে উদ্ভাসিত হয়ে আছে বাংলাদেশ নামক এক রঙিন মানচিত্র। এই শিল্পীর ক্যানভাসে লেপ্টে আছে মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, মুক্তিসংগ্রাম এবং দরদি নেতৃত্বের অসামান্য সব প্রতিচ্ছবি। শুধু কথায় নয়, তিনি ছিলেন অক্লান্ত কর্মবীর। চিন্তা ও কর্মের এমন সাযুজ্য সত্যি অবাক করার মতো। একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। সেই দেশটিকে কী করে সমৃদ্ধ এবং জনবান্ধব করা যায় সেই অর্থনৈতিক মুক্তিসংগ্রামেও তিনি ছিলেন অবিচল। আর তাঁর পরিকল্পিত উন্নয়নের কৌশলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়িয়েছিল। ছিল খাদ্যাভাব। ছিল অভাব। ছিল দারিদ্র্য। ছিল দুর্নীতি। কিন্তু তিনি পুরো সমাজের ও প্রশাসনের খোলনলচে বদলে দেওয়ার আমূল সংস্কারবাদী সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। নয়া ব্যবস্থায় খাদ্য উৎপাদন বাড়ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম এবং পাশাপাশি তেল ও খাদ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। তাই খাদ্যসহ জনগণের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম হয়ে উঠেছিল আকাশছোঁয়া। মূল্যস্ফীতি ছিল বাড়ন্ত। ঘাটতির অর্থনীতিতে চোরাকারবারি, মজুদদার এবং দুর্নীতিবাজরা ছিল সক্রিয়। আর উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং পাকিস্তানি নষ্ট কূটনীতিতে প্রভাবিত বিশ্ব মোড়লদের একাংশের খাদ্য সাহায্যকে ঘিরে চলছিল ভয়ংকর সব ভূ-রাজনৈতিক খেলা। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ঘরে ও বাইরে সাহসের সঙ্গে তাঁর গণমুখী রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনীতি সচল রেখেছিলেন। বিচক্ষণ মুদ্রানীতি, ডিমনিটাইজেশন, খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে তাঁর শাসনামলের শেষ দিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিলেন। আর কিছুদিনের মধ্যেই ম্যাক্রো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুরোপুরি অর্জনের সুদৃঢ ভিত্তি তিনি স্থাপন করে ফেলেছিলেন।

তবে দলের এবং দেশের ভিতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মীরজাফরদের শিরোমণি খন্দকার মোশতাক ছাড়াও অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিকরাও বিপ্লব-উত্তর একটি দেশের পুনর্নির্মাণে সহযোগিতার বদলে সর্বক্ষণ সমালোচনা করে চলছিলেন। অশান্তির বীজ বুনছিলেন। কোমলমতি অস্থির তরুণদের আরও অস্থির করে তুলছিলেন। আর আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর অন্দরমহলে তো চলছিল ষড়যন্ত্রের নানা কসরত। পাকিস্তানি ও প্রভাবশালী একটি পরাশক্তির গোয়েন্দাদের এসবে মদদ তো ছিলই। এমন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী রূপান্তরবাদী নেতৃত্বের গুণে দেশের অর্থনীতি দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন তিনি। কৃষকদের উন্নয়নের জন্য বীজ, সার ও ঋণ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। কৃষকদের ছাড়াও নগরের বেশিরভাগ মানুষের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাড়তি মনোযোগ দিয়েছিলেন সামাজিক সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহে। গ্রামপর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করাতে তিনি ছিলেন খুবই তৎপর। প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ ছাড়াও গ্রামগঞ্জে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে অগ্রাধিকার দেন। আর নিজ নিজ ধর্ম পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার দিয়ে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার না করার নীতি গ্রহণ করেন। সমাজের ভিতরে সাম্প্রদায়িকতার কারণে যাতে শান্তি বিনষ্ট না হয় সে জন্যই তিনি এই উদার নৈতিক ও আধুনিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন সম্প্রতি এলএসইতে এক ভার্চুয়াল আলোচনায় বলেছেন যে, শুধু এই নীতির কারণেই বিশ্ববন্ধু হওয়ার অধিকার রাখেন। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও তিনি শিক্ষা কমিশন, ইউজিসি স্থাপনসহ অনেকগুলো সংস্কারধর্মী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষিতে ২৪ শতাংশ বিনিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষা খাতে ৭.১ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছিলেন। বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছিলেন। সব ধরনের অবকাঠামো পুনর্বাসনে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। সারা দুনিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে তিনি ছিলেন খুবই তৎপর। এমনকি চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেও তিনি তাঁর বিচক্ষণ নীরব কূটনীতি অক্ষুণ রেখেছিলেন।

আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে এদেশেরই কিছু ক্ষমতালোভী কুসন্তান-পিশাচ বাঙালির মুক্তির এই মহানায়ককে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওরা ভেবেছিল এই হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বাঙালি জাতির হৃদয় থেকে চিরদিনের জন্য তাঁকে মুছে ফেলা যাবে। কিন্তু এমন একজন অফুরান প্রাণশক্তির রাজনীতির অমর কবিকে কি আসলেই হত্যা করা যায়? মোটেও না। তাই তো তিনি বেঁচে আছেন আমাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। তিনি চিরজাগ্রত আমাদের গল্পে, কবিতায়, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে। আছেন তিনি বাংলাদেশের অসংখ্য নদীর স্রোতধারায়, পাখির ডাকে, রবীন্দ্রনাথের গানে, নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় আর বিশাল সবুজ প্রান্তরে। শিশুদের কলকাকলিতে। দুঃখী মানুষের অন্তরজুড়ে। দিন দিন তিনি আরও বড় হচ্ছেন। বিরাট হচ্ছেন। ব্যাপক হচ্ছেন। কেননা তিনিই যে আমাদের ‘ডেস্টিনি’। তথা নিয়তি। তাঁর নামেই যে বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাসের দরজা নিমেষেই খুলে যায়। আর তাই তো অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ ২০০৯ সালে আমার লেখা  ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম’ বইটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন যে, ‘ব্যক্তি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা, আমার বিবেচনায় অত্যন্ত ব্যতিক্রমী, দলছুট এক ঘটনা।’ তিনি আরও জানিয়েছেন যে, সমগ্র বাংলায় প্রাক-সাতচল্লিশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জগতে সবাই কোনো না কোনো বিচারে ‘অভিজন’ পর্যায়ে ছিল। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্য ছিল খুবই স্পষ্ট। তাই তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর অসামান্যতা ছিল তাঁর আত্মপরিচয়ের অহংকারে : তিনি যে কৃষকের সন্তান তা নিজে কখনো ভোলেননি এবং কাউকে ভুলতে দেননি তো বটেই এমনকি কৃষককে ভোলা চলবে না বাংলার মানুষেরও, এই দাবি ও স্বীকৃতি আদায়ে অনড় ছিলেন।’ লেখক  হায়াৎ মামুদের মতে, বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠা হলো একজন কৃষক সন্তানের হাত ধরে নিঃসন্দেহে সে এক বিরল ঘটনা। আর তার আরাধ্য বাংলাদেশ অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি প্রবেশ করল এক নতুন যুগে। এই নয়া বাস্তবতায় আমাদের অভিজন শ্রেণির নেতৃত্বের প্রস্থান ঘটেছে ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারায়। তবে তাদের হিংসে ও পরশ্রীকাতরতায় কোনো ঘাটতি ছিল না। তাই রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃশ্যপট থেকে বাহ্যত সরে যাওয়া সেই তথাকথিত ‘অভিজন’দের প্রেতাত্মারা মরণ আঘাত হেনেছিল পঁচাত্তরের সেই কালরাতে। শতকষ্ট ও দুঃখের মাঝেও প্রশান্তির বিষয় এই যে তাঁরই কন্যার নেতৃত্বে বাঙালি তার পিতৃহত্যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত অনেকটাই সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের জন্য বড় কাজ হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও কর্মকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরা। তাঁর জন্মবার্ষিকীতে আমরা কিছুটা হলেও এ কাজটি করতে সক্ষম হয়েছি। তবে করোনা এসে বাদ সেধেছে বলে সেই উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তা সত্ত্বেও আমাদের সর্বদাই সচেষ্ট থাকতে হবে তাঁর সামাজিক সুবিচার ও মানবিকতানির্ভর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কৌশলকে কী করে বাস্তবায়ন করা যায় সেই লক্ষ্যে। অবশ্যই আমাদের ‘সোনার বাংলা’ অভিমুখের জয়যাত্রাকে অক্ষুণœ ও অবিচল রাখার অভিপ্রায়কে পুরো সমাজের অন্তরে নিরন্তর জাগিয়ে রাখতে হবে।

আর সে কারণেই তরুণ প্রজন্মের মনে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে তাদের আগ্রহ নিরন্তর সচল ও সজীব রাখতে হবে। তাঁকে নিয়ে অবশ্য আমাদের সমাজ ও সাহিত্যে আগ্রহের অভাব নেই। তাই তো তাঁকে নিয়ে এত লেখালেখি। আমার ধারণা, পৃথিবীর আর কোনো জাতির পিতা এবং রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে এত কবিতা, গান, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ লেখা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে ঘিরে এত লেখালেখি হয়েছে যা এককথায় কল্পনাতীত। হয়তো কালের কষ্টিপাথরে এসব লেখার অনেকাংশই ঝরে পড়বে। তারপরও এ কথা ঠিক যে, অনেক লেখাই কালোত্তীর্ণ হবে। হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা এবং গবেষণানির্ভর লেখাগুলো নিশ্চয় যুগ যুগ ধরে পাঠকের মনে বাসা বাঁধবে। বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মনে বঙ্গবন্ধুকে স্থায়ীভাবে গেঁথে দিতে চাইলে তাঁকে নিয়ে শ্রমসাধ্য লেখালেখির কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সমাজের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ও পন্ডিতজন যাঁরা, তাঁরা যদি একটু কষ্ট করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরও লেখেন তাহলে তরুণ প্রজন্ম খুবই অনুপ্রাণিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। অসংখ্য লেখার মধ্য থেকে তাঁদের লেখাগুলো ঠিকই খুঁজে বের করে নিতে তরুণ পাঠকদের অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। আর সে কারণেই আমাদের গবেষকদের কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব। গভীর প্রত্যাশা আমরা যেন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহনেতাদের নিয়ে আরও নিবিড়ভাবে গবেষণা করি। মুক্তিযুদ্ধের মানুষ ও স্বপ্ন নিয়ে নিবিড় গবেষণার সুযোগ কিন্তু আমাদের আশপাশেই রয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিরল প্রজন্ম যদ্দিন বেঁচে আছেন তদ্দিন তাঁদের কাছ থেকে উপযুক্ত তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে এদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিপুল সুযোগ রয়েছে। বলতে ভালো লাগছে যে ইউজিসি এরই মধ্যে সব উচ্চশিক্ষালয়ে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোর্স চালু করেছে। তারা বঙ্গবন্ধুর তারুণ্য ও শিক্ষাভাবনা নিয়ে দুটো বিস্তৃত গবেষণা পরিচালনারও উদ্যোগ নিয়েছেন। এভাবেই সব উচ্চশিক্ষালয়কে নিজেদের ইতিহাস ও নেতৃত্বকে জানার এবং বোঝার জন্য ব্যাপকভাবে গবেষণা ও প্রাণবান পাঠক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনালগ্ন করে রাখার এটিই কাক্সিক্ষত উপায় হতে পারে। নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর জীবন, তাঁর চিন্তা ও কর্ম তরুণ প্রজন্মের জন্য উপযুক্ত পাঠক্রম হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর থেকে শুরু করে কলকাতা ও ঢাকায় তাঁর ছাত্রজীবন ও নেতৃত্বের ওপর নতুন করে গবেষণার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তাঁর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে আন্দোলনে অংশগ্রহণ নিশ্চয় গবেষকদের বিশেষ আগ্রহের বিষয় হতে পারে। তাছাড়া পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষায় কথা বলার পক্ষে তাঁর জোরালো দাবি এবং পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখ ও বঞ্চনার পক্ষে তিনি যেসব বক্তৃতা করেছেন সেগুলো বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের রসদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এসব কিছুই হতে পারে আমাদের তরুণদের বিপুল আগ্রহের বিষয়। তরুণরা এ কথা জেনে খুশি হবে যে মূলত তিনিই দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে একটি উদার ধর্মনিরপেক্ষ দলে পরিণত করেন। উল্লেখ্য, মাঝে কিছুদিনের মন্ত্রিত্ব করে পুরোপুরিভাবে দল গোছানোর কাজে নিজের সাংগঠনিক সক্ষমতার পুরোটাই ঢেলে দেন। দলকে শক্তিশালী করার এক পর্যায়ে দেশ চলে যায় সামরিক শাসনের অধীনে। আর বঙ্গবন্ধুকে যেতে হয় দীর্ঘদিনের জন্য জেলে। আইয়ুব খানের শাসনামলে তাঁকে আরও বহুবার জেলে যেতে হয়। দুই বছরেরও বেশি সময় জেলে থাকার পর ষাট দশকের শুরুতেই তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পেলেও প্রকাশ্যে রাজনীতির সুযোগ থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়। কিছুদিন নীরব থাকার পর ফের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধেই তিনি এবং তাঁর দল রাজনীতি করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগকে এককভাবেই চাঙা করেন।

শুরুতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালালেও এক পর্যায়ে দলের সভাপতির দায়িত্ব নেন। তদ্দিনে তিনি বাঙালির মুক্তিসনদ ছয়-দফা ঘোষণা করেছেন। ছয়-দফার পক্ষে পুরো দলকে উজ্জীবিত করার পাশাপাশি পূর্ব বাংলার শ্রমিক কৃষক-সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন পেতে থাকেন। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই তাঁকে জেলে ভরা হয়। এদিকে ছয়-দফাও জনপ্রিয় হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১ নম্বর আসামি করে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব’ মামলা দেওয়া হয়। এই মামলা বরং তরুণ সমাজ ও সাধারণ মানুষের কাছে তাঁকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলে। ঊনসত্তরের শুরুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে তাঁকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব সরকার। মুক্তি পাওয়ার পরের দিন ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে বঙ্গবন্ধু গণউপাধি দেওয়া হয়। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁর নামের অংশ হয়ে যায়। এরপর আইয়ুব সরকারের পতন ঘটল। এলো আরেক সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘোষণা করলেন জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ। বঙ্গবন্ধু সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাঁর দলকে নিরঙ্কুশ বিজয়ী করলেন। শুরু হলো ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র। এক পর্যায়ে সাংবিধানিক অধিবেশন ডেকেও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। শুরু হরো অসহযোগ আন্দোলন। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা ঘোষণায় গড়াল। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। আর বাঙালি শুরু করল মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলো।

আর স্বাধীন দেশে পা রেখেই তিনি ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী) ময়দানে বলেছিলেন যদি তিনি মানুষকে খাবার না দিতে পারেন, যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারেন তাহলে এই রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলেছিলেন দেশ থেকে ঘুষ ও দুর্নীতি দূর করতে হবে।

এসব লক্ষ্য পূরণের জন্য তিনি গণমুখী সংবিধান, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, শিক্ষা কমিশনসহ কত সুদূরপ্রসারী উদ্যোগই না নিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের শত্রুরা এই মহান নেতার স্বপ্নপূরণের পথকে আপাতত হলেও রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বদেশকে তারা পাকিস্তানের অভিমুখে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ফলে মানুষের মনে দারুণ হতাশা বাসা বাঁধে। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম শেষে ফের দেশ ফিরেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে। বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে। বিশ্ব মহামারী ও মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে সাহসের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সামনে রয়েছে প্রচুর চ্যালেঞ্জ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দারিদ্র্য নিরসন, কর্মসংস্থান, দুর্নীতি ও অনাচার দূর করার জন্য ন্যায্য শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করার মতো অসংখ্য চ্যালেঞ্জ যে আমাদের মোকাবিলা করেই সামনের দিকে এগোতে হবে সে কথা কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। তবে আমরা এই কারণে আশাবাদী যে, প্রতিকূল পরিবেশকে বাগে এনে এগিয়ে চলার এক অনন্য সংস্কৃতি বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশবাসীর জন্য রেখে  গেছেন। লড়াই করে এগিয়ে যাওয়ার সেই সংস্কৃতিই হতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক পুঁজি। এ পুঁজি যত ব্যবহার করা যায় তা ততই আরও বাড়বে। তাই আমরা নিশ্চয় আশা করতে পারি যে, বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই আমরা পৌঁছে যেতে পারব আমাদের কাক্সিক্ষত সমুন্নত সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলায়’। কেননা তিনিই যে বাঙালির অফুরান প্রাণের প্রধানতম উৎস। আমাদের ভরসার বাতিঘর। শেষ করছি মহাদেব সাহার ‘শেখ মুজিব আমার নতুন কবিতা’র লাইনগুলো উদ্ধৃতি করে।

আমি আমার কবিত্ব শক্তি উজাড় করে যে-কবিতা লিখেছি তার নাম শেখ মুজিব,

এই মুহূর্তে আর কোনো নতুন কবিতা লিখতে পারবো না আমি

কিন্তু এই যে প্রতিদিন বাংলার প্রকৃতিতে ফুটছে নতুন ফুল শাপলা-পদ্ম-গোলাপ

সেই গোলাপের বুক জুড়ে ফুটে আছে মুজিবের মুখ

এদেশের প্রতিটি পাখির গানে মুজিবের প্রিয় নাম শুনি,

মনে হয় এরা সকলেই আমার চেয়ে আরো বড় কবি।

শেখ মুজিবের নামে প্রতিদিন লেখে তারা নতুন কবিতা

মুজিব গোলাপ হয়ে ফোটে, লাল পদ্ম হয়ে ফোটে হৃদয়ে হৃদয়ে,

আমার না-লেখা প্রতিটি নতুন কবিতা জুড়ে গাঁথা আছে তার নাম,

তার মুখচ্ছবি লিখি বা না লিখি শেখ মুজিব বাংলা ভাষায় প্রতিটি নতুন কবিতা।

বঙ্গবন্ধুর আত্মার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।

সর্বশেষ খবর