সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা চলবে

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা লেখালেখি তাঁর মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণামূলক কাজ চলছে এবং বহুদিন চলবে...

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা চলবে

প্রণব মুখার্জি

মুজিবুর রহমানের বিশাল কর্মময় জীবন যা তাঁর ধৈর্য, মানসিকতা, দৃঢ়তা এবং অপরিসীম আত্মসংযমের পরিচায়ক, তার সামগ্রিক মূল্যায়ন করা দুরূহ। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের রাতে মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী করাচিতে বন্দি হিসেবে নিয়ে আসে। করাচি বিমানবন্দরে দুজন মিলিটারি অফিসারের সঙ্গে তোলা তাঁর ছবি বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলে ছিলেন। সেটি রাওয়ালপিন্ডির কাছে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের কোনো খবর তাঁর কাছে ছিল না। এই সময়ে মানসিক এবং শারীরিক চাপ তৈরির জন্য প্রচ- গরম এবং নিদারুণ ঠান্ডার মধ্যে প্রায় ৯ মাস তাঁকে রাখা হয়। একটি মাত্র কম্বল শীত নিবারণের জন্য দেওয়া হয়েছিল। কোনো ডাক্তারি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়নি। একজন মিলিটারি অফিসার হিসেবে জেল গভর্নর মাঝে মাঝে আসতেন। যুদ্ধের খবরও তাঁর কাছে ছিল না।

জেলে বসে আকাশে যুদ্ধবিমানের ব্যস্ততা দেখে এবং মিলিটারি প্রহরীদের নিজেদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে তিনি আভাস পেতেন ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বোধহয় যুদ্ধ হচ্ছে। ডিসেম্বর ২৬ পর্যন্ত এই কারাগারেই বন্দি ছিলেন তিনি। তার পর শেষ রাতে জেল গভর্নর একটি ট্রাকের মধ্যে করে খড়ের ওপর শুইয়ে পাহাড় এবং জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রবল বৃষ্টির মাঝে তাঁকে কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আসেন। তিনি এটুকুই বলেন, ‘জেলে আপনার জীবন বিপন্ন। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আপনাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।’ এ ছাড়া কোনো সংবাদ তাঁকে দেওয়া হয় না। তবে তাঁকে একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন বাংলোয় (যেটি ছিল জেলারের অফিশিয়াল রেসিডেন্স) নিয়ে আসা হয়। স্নানের সুযোগ, শীতনিবারক বস্ত্র, শেভিং কিটসহ কিছু সুবিধাও দেওয়া হয়, যেসব থেকে তিনি ৯ মাস বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু সংবাদপত্র, রেডিও, টিভি অথবা টেলিফোন ব্যবহার করার সুযোগ তাঁকে তখনো দেওয়া হয় না। পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি বিকালে তাঁকে একটি স্টাফ কারে করে দুজন মিলিটারি অফিসার আরেকটি বাংলোয় নিয়ে আসেন। সেটি ছিল রাওয়ালপিন্ডি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। সেখানে বিকালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। ভুট্টো নিজেই বলেন, তিনি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিবুরের সহযোগিতা চান। ১ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই কদিন ভুট্টো বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন এবং চাপ সৃষ্টি করেন যাতে তিনি ভুট্টোর সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে সই করেন।  অনেকগুলো খসড়া তিনি মুজিবকে দেখান। মুজিব প্রথমেই প্রশ্ন করেছিলেন তিনি জেল থেকে মুক্ত কি না। নাকি মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে আসলে অন্য কারাগারে বন্দি হয়েছেন, যেখানে জীবনযাত্রা আরামপ্রদ এবং সুসহ। এখানে থাকার সময়েই তিনি খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু কাগজ এবং পত্রপত্রিকা যেগুলো তাঁর কাছে পৌঁছত, সেখানে বিভিন্ন সংবাদ কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ‘টাইম’ পত্রিকার একটি কপি তাঁর হাতে পৌঁছায়, যেটিতে কাটাকুটি ছিল না। সেখানে একটি প্রবন্ধে মুজিব দেখেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শেখ মুজিব আগামী দিনে দেশের কোন কোন সমস্যার ওপর জোর দেবেন তা নিয়ে একটি আলোচনা রয়েছে। পাশাপাশি একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, মুজিব কোথায়? যদি জীবিত থাকেন তাহলে একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে কীভাবে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি রাখা হয়? আরও অনেক বিষয়ে আলোচনা সেখানে তিনি দেখতে পান।

এদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপনের জন্য মুজিবের কাছে বারবার আবেদন করেন। যে সম্পর্ক পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখবে। মুজিব শুধু জানান, তিনি তার দেশের মানুষের সঙ্গে কথা না বলে ভুট্টোর সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত ভুট্টো হতাশ হয়ে মুজিবকে ব্রিটেনে পাঠানোর মনস্থ করেন। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের মাঝরাতে তাকে পাক এয়ারলাইনসের একটি বিশেষ বিমানে একটি মাত্র যাত্রী হিসেবে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনের হিথ্রোয়। তিনি যখন হিথ্রোয় নামেন স্থানীয় সময় তখন ভোর সাড়ে ৬টা। তার আগেই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে হিথ্রো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে যে, মুজিবকে নিয়ে একটি বিমান নির্দিষ্ট সময়সূচি ছাড়াই লন্ডনে পাড়ি দিয়েছে। যেন ওই বিমানকে নামতে দেওয়া হয় এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে এই সংবাদটি জানানো হয়। সরাসরি ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা হিথ্রো থেকেই তাকে নিয়ে ক্ল্যারিজস হোটেলে পৌঁছান এবং খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে বসবাসকারী বাঙালিরা ওই হোটেলে এসে মুজিবের সঙ্গে দেখা করে নিজ নিজ প্রাপ্ত সংবাদ জানাতে থাকেন। মুজিব দেশের খবর পান। অবশ্য ভুট্টো কথা প্রসঙ্গে আগেই তাকে জানিয়েছিলেন, তার পরিবারের সবাই জীবিত রয়েছেন। পিতা-মাতা পর্যন্ত।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা লেখালেখি তার মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণামূলক কাজ চলছে এবং বহুদিন চলবে। তিয়াত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতের লেখায় একটি নোটবইয়ে তাঁর একটি মন্তব্যের বঙ্গানুবাদ দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। এই উদ্ধৃতির মধ্যেই তাঁর পরিপূর্ণ পরিচয় বিধৃত রয়েছে- “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবী। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে”।

লেখক : ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি।

সর্বশেষ খবর