সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

শোক থেকে শক্তি, যে চেতনার মৃত্যু নেই

দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে বাঙালির ইতিহাস কলঙ্কমুক্ত হয়

শোক থেকে শক্তি, যে চেতনার মৃত্যু নেই

তোফায়েল আহমেদ

১৫ আগস্টের কালরাতে শাহাদাতবরণকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ পরিবারের সবার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সে দিনের নৃশংস হত্যাকান্ডের মাধ্যমে খুনিচক্র দেশের অগ্রগতিকে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সব অর্জনকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সংবিধানের ওপর কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি বিল’ চাপিয়ে খুনিচক্রের দোসর সামরিক সরকার এই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিল। ২১ বছর সংগ্রাম শেষে ১৯৯৬-এ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন এবং ‘ইনডেমনিটি বিল’ সংবিধান থেকে অপসারণ করে। প্রচলিত আইনে একজন বিচারপ্রার্থী বিধানানুযায়ী যে সুবিধাদি পান, সেভাবেই চলে বিচারিক প্রক্রিয়াটি। দীর্ঘ সওয়াল-জবাব শেষে বিজ্ঞ আদালত খুনিদের ফাঁসির রায় ঘোষণা করে। ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে বিচারের রায় অকার্যকর ও খুনিচক্রকে রক্ষা করতে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে। এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ রাজপথে-সংসদে সংগ্রাম করে ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে গণরায়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। ফলে খুনিচক্রের দন্ডাদেশ কার্যকরের পথ অর্গলমুক্ত ও দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে বাঙালির ইতিহাস কলঙ্কমুক্ত হয়। সমগ্র জাতি সেদিন কী হারিয়েছিল তা সামগ্রিকতায় উপলব্ধির দিগন্ত উন্মুক্ত হয়।

বঙ্গবন্ধু সমগ্র জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, বাংলা ও বাঙালির মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। এই সাধনার শুরু ’৪৭-এ দেশভাগের পরপরই; ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠন করেন। সেই থেকে ধাপে ধাপে প্রতিটি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব ’৪৮-এর ১১ মার্চে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বে ’৪৮-এর ১১ মার্চ ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী আমি। বঙ্গবন্ধুর কাছেই শুনেছি, তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উপলব্ধি করেছি, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।’ সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে মহান ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে সমগ্র জাতিকে জাতীয় মুক্তির এক মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কোনো দিন মাথানত করেননি। আজ তিনি টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত। আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না, দরদি কণ্ঠে বাঙালি জাতিকে ডাকবেন না ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে। তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সোনার বাংলা কায়েম করা। গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বাংলাদেশ হবে রূপসী বাংলা, সোনার বাংলা, প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড।’

’৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হই। ’৭০-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এই দিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সমাবেশে বঙ্গবন্ধু আমার গুণবাচক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বক্তৃতা করেন। তিনি নেতা-কর্মীদের এভাবেই সম্বোধন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন সে এলাকার সংগঠক বা নেতা-কর্মীকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক হয়েছেন, সংগঠক থেকে নেতা হয়েছেন, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে উন্নীত করেছেন জাতীয় নেতায়। ফলত সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে টিকে আছে।

’৭১-এর ৩ জানুয়ারি, রেসকোর্স ময়দানে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সে দিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘ছয় দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। ছয় দফা আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘আমাকে মোনয়েম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি-কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।’ বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। কবিগুরুর ভাষায়, ‘আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’

লেখক : সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

সর্বশেষ খবর