সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

বিএনপি সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার পথ বন্ধ করেছিল

জিয়ার স্ত্রীর নেতৃত্বের সরকারও এমন ব্যবস্থা করেছিল যাতে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরত আনা না যায়...

বিএনপি সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার পথ বন্ধ করেছিল

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

এক দেশে অপরাধ করে বা দন্ডিত হয়ে কোনো আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি অন্য দেশে পালিয়ে গেলে তাকে অপরাধ করা দেশে ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন বৈকি। অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভবও বটে। তবে কয়েক শতক ধরেই পালিয়ে যাওয়া আসামিদের অপরাধ করা দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, কেননা, এটি সব দেশের জন্যই মঙ্গলকর। যে আইনটি এ ব্যাপারে সর্বাধিক প্রযোজ্য এবং কার্যকর, আইনের ভাষায় তার নাম ‘এক্সট্রাডিশন আইন’ যাকে বাংলায় ‘আসামি হস্তান্তর’ আইন বলা যেতে পারে। অনেকে একে ভুল করে ‘বন্দিবিনিময় আইন বলে’ থাকেন, যা ঠিক নয়। এক্সট্রাডিশন বা আসামি হস্তান্তর এবং বন্দিবিনিময় আইনে রয়েছে বেজায় ফারাক। এক্সট্রাডিশন বা আসামি হস্তান্তর আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি একটি দেশে অপরাধে অভিযুক্ত হলে, অথবা সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ভিন্ন কোনো দেশে পালিয়ে গেলে, পালিয়ে যাওয়া দেশটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে উপযুক্ত ক্ষেত্রে অপরাধের দায়ে অভিযোগ করা দেশটিতে ফেরত পাঠাতে পারে। এটি বিচারাধীন আসামি এবং দন্ডপ্রাপ্ত উভয়ের বেলায় প্রযোজ্য। এক্সট্রাডিশন ছাড়াও পালিয়ে যাওয়া দেশের ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ীও আসামি/সাজাপ্রাপ্তকে অপরাধ করা দেশে পাঠানো সম্ভব। তবে এক্সট্রাডিশনই বেশি প্রযোজ্য এবং কার্যকরী।

আন্তর্জাতিক আইনের জনক হুগো গ্রসিয়াস ১৬ শতকেই পালিয়ে যাওয়া আসামি হস্তান্তরের কথা উল্লেখ করলেও, আন্তর্জাতিক আইনে এক্সট্রাডিশনের ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, সব নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নিজস্ব আইনের ওপর। কয়েকটি সীমিত দেশ ছাড়া বেশির ভাগ দেশেই এক্সট্রাডিশনের অনেক শর্তের মধ্যে মুখ্য শর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তি। যেসব দেশের এক্সট্রাডিশন আইনে চুক্তির প্রয়োজনীয়তার শর্ত রয়েছে, সেসব দেশ চুক্তিবহির্ভূত দেশে আসামি বা সাজাপ্রাপ্তকে এক্সট্রাডিশন আইন অনুযায়ী ফেরত পাঠাতে পারে না, যদিও সংশ্লিষ্ট দেশের ইমিগ্রেশন আইনে তা সম্ভব হতে পারে। বিষয়টির জন্ম আদিতে আন্তর্জাতিক আইনের গর্ভে হলেও বর্তমানে এটি প্রায় সব দেশেই মূলত সে দেশের সাংবিধানিক বা ফৌজদারি আইনভুক্ত। ১৮ শতকের পূর্বে খুব কম ক্ষেত্রেই সাধারণ অপরাধীদের ফেরত পাঠানো হতো এবং সে সময়ে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে চুক্তির অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু ১৯ শতকে রেলওয়ে এবং জাহাজ চলাচলে বিপ্লব ঘটায়, অপরাধীদের বিদেশে পালানোর বিভিন্ন পন্থা বের হলে, রাষ্ট্রসমূহ তাদের নিজ নিজ স্বার্থে অপরাধীদের অপরাধ করা দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করতে শুরু করলে, অপরাধীদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ চুক্তির প্রয়োজনীয়তা তীব্রতর হয়। সে সময় স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির তুলনায় বহুপক্ষীয় চুক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে সে পথে এগোলেও সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ১৯০২ সালে প্যান-আমেরিকান কনফারেন্স একটি এক্সট্রাডিশন চুক্তিতে ১২টি দেশ দস্তক্ষত করলেও, শেষ পর্যন্ত তা গৃহীত হয়নি। ১৯২৭ সালে প্যান-আমেরিকান আন্তর্জাতিক জুরিস্টদের প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। ১৯৩০ সালে হ্যাগ কোডিফিকেশন কনফারেন্স উল্লেখ করেছিল এক্সট্রাডিশনের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রযোজ্য কোনো বিধান কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইনে নেই। ১৯৩৫ সালে হার্ভার্ডের গবেষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এক্সট্রাডিশনের জন্য যে বিধান তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল, তাও সফল হয়নি এবং তারা উল্লেখ করেছিলেন আন্তর্জাতিক আইনে এক্সট্রাডিশন চাওয়ার কোনো স্বয়ংক্রিয় অধিকারের স্বীকৃতি নেই। অবশ্য ব্রিটিশ সরকার ১১৭৪ সালে রাজা দ্বিতীয় হেনরির আমলেই এক্সট্রাডিশনের জন্য আন্তর্জাতিক বিধানের পক্ষে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। বর্তমানে এক্সট্রাডিশনে কোনো আন্তর্জাতিক কনভেনশনের অস্তিত্ব নেই, রয়েছে মূলত দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তি। কোনো কোনো দেশ আবার চুক্তি ছাড়াই নির্ধারিত দেশে ফেরত পাঠাতে পারে যেমন যুক্তরাজ্য বাংলাদেশসহ বেশকটি দেশে, এবং বাংলাদেশও একইভাবে চুক্তি ব্যতিরেকেই যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে আসামি/সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ফেরত পাঠাতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বহুজাতিক ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে। ১৯৬৭ সালে কমনওয়েলথ আইনমন্ত্রীদের সম্মেলনে এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহে বিনা চুক্তিতেই আসামি হস্তান্তর করা যাবে। এটি কোনো বহুজাতিক চুক্তির মর্যাদা পায়নি, ছিল একটি ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা মাত্র। যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশসহ কিছু কিছু কমনওয়েলথ দেশ এই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করে তাদের নিজ দেশে আইন প্রণয়ন করেছে।

এক্সট্রাডিশনের ব্যাপারে বাংলাদেশ বেশ দুর্বল অবস্থানে রয়েছে কেননা তার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তিভুক্ত দেশের সংখ্যা খুবই কম। উল্লেখযোগ্য দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য যে দেশ থেকে আসামি/সাজাপ্রাপ্ত মানুষ ফিরিয়ে আনতে চুক্তির দরকার নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আসামি/সাজাপ্রাপ্তদের ফিরিয়ে আনার প্রথম শর্ত হচ্ছে এক্সট্রাডিশন চুক্তি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে বিএনপি নেতাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বেশ কিছু খুনি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের চুক্তি করার প্রয়োজনীয়তা প্রাধান্য পায়। সেই বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনকে অনুরোধ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু খুনিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে। বিল ক্লিনটন তখন বিষয়টি নিয়ে তার সেক্রেটারি অব স্টেট ম্যাডেলিন অলব্রাইটের সঙ্গে আলাপ করলে, তিনি বিল ক্লিনটনকে জানান যে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয চুক্তি করতে হবে। ওয়াশিংটন তাতে প্রাথমিকভাবে সম্মত হলে বাংলাদেশ থেকে আইনবিদ এবং অন্য বিশেষজ্ঞদের ওয়াশিংটন পাঠানোর পরামর্শ দেন আলোচনার জন্য। সে মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী সদ্য অবসরে যাওয়া পররাষ্ট্র সচিব জনাব শফি সামিকে প্রতিমন্ত্রীর পদ প্রদান করে তার নেতৃত্বে মোট পাঁচ সদস্যের একটি দল ওয়াশিংটন পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যাতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে আমাকে (আমি তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং মাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সমাপ্ত হওয়ার পর কিছুটা ব্যস্ততামুক্ত ছিলাম), আইন মন্ত্রণালয়ের সে সময়ের যুগ্ম সচিব জনাব আনোয়ারুল হক, যিনি পরে যথাক্রমে আইন সচিব, হাই কোর্ট এবং আপিল বিভাগের বিচারপতি পদে উন্নীত হয়েছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক জনাব মুন্সি ফয়েজ আহমেদ, যিনি পরে রাষ্ট্রদূত এবং বিআইএস স্ট্যাডিজের সভাপতির পদ পেয়েছিলেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জনাব জানেবুল হক, যিনি পরে হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। আমরা পাঁচজন ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটন পৌঁছলে সেখানে আমাদের দলের সঙ্গে সংযুক্ত হন যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব তারিক করিম সাহেব। ১৫ এপ্রিল থেকেই আমরা ওয়াশিংটনস্থ যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক শুরু করি। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত (মাঝখানে এক ঘণ্টা দুপুরের খাবার বিরতিসহ, যার ব্যবস্থা স্টেট ডিপার্টমেন্টই করত) একটানা পাঁচ দিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় মিলিত হয়েছিলাম। আমরা যেমন পাঁচজন সদস্য ছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও তেমনি ছিলেন পাঁচজন, স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক শীর্ষ কর্মকর্তা মি. হ্যারি মার্শালের নেতৃত্বে, যাদের বহু জটিল প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল আমাদের। আইন সংক্রান্ত প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল আমার এবং সে সময়ের আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আনোয়ারুল হক সাহেবের ওপর। অন্যান্য বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন যথাক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জানেবুল হক সাহেব এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুন্সি ফয়েজ আহমেদ সাহেবকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের অতি অভিজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন রাষ্ট্রদূত জনাব তারিক করিম সাহেবও তার আওতাধীন বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। গোটা আলোচনার নেতৃত্বে এবং রূপরেখা নির্ধারণে ছিলেন জনাব সফি সামি সাহেব। আমাদের জন্য প্রটোকলের দায়িত্বে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের দূতাবাসের প্রথম সচিব জনাব জুলকারনাইন সাহেব, যিনি বর্তমানে আলজেরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। মার্কিন কর্মকর্তাদের প্রশ্নের ধারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল আমাদের আইন আদালত সম্পর্কে তারা আগে থেকেই অনেক কিছু জেনেশুনেই বৈঠকে এসেছেন। মার্কিন কর্মকর্তাদের মূল প্রশ্নগুলো ছিল আমাদের দেশে আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারে স্বচ্ছতা, আসামিদের আইনি অধিকার এবং প্রতিরক্ষা, জামিন সংক্রান্ত আইন-সাংবিধানিক অধিকার, পুলিশের ভূমিকা এবং টাকা পাচার রোধ সংক্রান্ত আইন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল মার্কিন সরকার যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের দূতাবাসে একটি পত্রের মাধ্যমে তাদের (১) সংবিধান, (২) সংবিধানের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক সিদ্ধান্ত সমূহ এবং (৩) টাইসন বনাম অ্যারিজোনা মামলার রায়ের কপিসমূহ পাঠিয়েছিলেন।

তারা আগেই যে প্রশ্নগুলো আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেগুলোর মধ্যে ছিল (১) বাংলাদেশে স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠনের বিষয়টি এখন কোন অবস্থায় রয়েছে? (২) শোনা যায় বাংলাদেশে আটক ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা খুবই ব্যাপক, যা কি না জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের খেলাপ এবং যুক্তরাষ্ট্র এমন নির্যাতন চলা দেশে কাউকে ফেরত না পাঠাতে বদ্ধপরিকর। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে আটক ব্যক্তিদের নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেওয়ার কী বিধান রয়েছে? (৩) ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত নোটের জবাব দিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে যে আইনি গাইডলাইন পাঠিয়েছিল, তার উল্লেখ রয়েছে, এফবিআই-এর হ্যান্ডবুকে। বাংলাদেশ পুলিশও কি একই ধরনের গাইডলাইন অনুসরণ করে বা করবে? (৪) বাংলাদেশে সম্প্রতি কালে এমন কোনো পুলিশের বা অন্য কর্তৃপক্ষের বিচার এবং শাস্তি হয়েছে কি না, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে? (৫) গত নভেম্বরের ১৩ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত দুজন মার্কিন ফৌজদারি তদন্ত কর্মকর্তা বাংলাদেশের পুলিশকে মানুষের মর্যাদার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ঢাকা গমন করেছে, তারা কি আরও কিছু বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে? (৬) বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করার দাবি জানিয়েছে, যে আইন বলে যে কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক রাখা যায়। এ আইন রোধ কল্পে কী করা হচ্ছে? (৭) বাংলাদেশে মামলার জটের কারণে বিচার শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই আসামিদের দীর্ঘ সময় হাজতে থাকতে হয়, এর সমাধানে কী করা হচ্ছে? (৮) বিচার বিভাগে দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়, বিশেষ করে নিম্ন আদালতসমূহে, যেগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত। এ ব্যাপারে কী করা হচ্ছে? যে সব আসামি মামলার খরচ বহনে অক্ষম তাদের ব্যাপারে কী করা হয়? (৯) এক্সট্রাডিশন চুক্তি সই হলে, যুক্তরাষ্ট্রকে এক সময়ে তার নিজ নাগরিককেও বাংলাদেশে পাঠাতে হতে পারে। সে অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত হতে চায় যে বাংলাদেশে জেলখানার অবস্থা বিশ্বমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তার নিশ্চয়তা কী? (১০) শোনা যায় বাংলাদেশে জেলখানায় নির্যাতন, ধর্ষণ, ওভার ক্রাউডিং ইত্যাদি বিদ্যমান, তার জবাব কী? তারা আমাদের দেশে বিচারাধীন আসামিদের জামিনের বিষয় নিয়েও অনেক প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রতিদিনই আমরা বৈঠক শেষে হোটেলে গিয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটাতাম প্রশ্নগুলো এবং আরও সম্ভাব্য প্রশ্নের জবাব তৈরি করার জন্য। এ ধরনের ব্যাপক অনুশীলনীর কারণে আমরা অনেকটা নির্বিঘ্নেই মার্কিন কর্মকর্তাদের প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দিতে সক্ষম হয়েছিলাম, যে কথাটি পরবর্তীতে হ্যারি মার্শাল সাহেব ২০০১ সালের ২২ মে আমাদের আইন মন্ত্রণালয়কে পাঠানো পত্রে পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ করে লিখেছিলেন- “We thought our negotiations were quite successful and we look forward to taking our internal steps of great importance” যা বাংলায় তরজমা করলে দাঁড়ায় “আমরা মনে করছি আমাদের আলোচনাগুলো খুবই সফল হয়েছে এবং আমরা এ বিষয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।” যা সে সময়ের আইনমন্ত্রী জনাব আবদুল মতিন খসরু সাহেব সম্মেলনে যোগ দেওয়া যুগ্মসচিব জনাব আনোয়ারুল হক সাহেবসহ অন্যদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমাদের পাঁচ দিনের বিরতিহীন আলোচনা শেষে মার্কিন দলের নেতা হ্যারি মার্শাল সাহেব প্রকাশ্যেই এবং স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছিলেন তিনি এবং তার দলের সদস্যরা বাংলাদেশ সম্পর্কে যা জানতে চেয়েছিলেন, তাতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাই তিনি খসড়া চুক্তিতে সই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর সেই খসড়ায় বাংলাদেশের পক্ষে সই করেছিলেন আমাদের দলনেতা জনাব সফি সামি এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষে সই করেছিলেন মি. হ্যারি মার্শাল। সইয়ের পর মি. মার্শাল আমাদের জানালেন আমেরিকান আইন অনুযায়ী বিষয়টি এখন মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদ সিনেটে যাবে তাদের সিদ্ধান্তের জন্য। সব শেষে মি. মার্শালের নেতৃত্বে আমাদের নৈশভোজে আপ্যায়ন করা হলো ওয়াশিংটনের একটি পাঁচতারকা হোটেলে। আলোচনা চলাকালে এক দিন রাষ্ট্রদূত জনাব তারিক করিম সাহেব আমাদের এবং যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ তদন্ত বিভাগ এফবিআইয়ের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে তার বাড়িতে নৈশভোজে আপ্যায়ন করেছিলেন। সে সময়ে এফবিআই কর্মকর্তারা আমেরিকায় পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ঠিকানাসহ অনেক তথ্যই আমাদের কাছে প্রকাশ করে এ কথাও বলেছিলেন যে আমেরিকান পুলিশ তাদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি চালাচ্ছে। সম্মেলন শেষে আমরা বাংলাদেশে ফিরে এসে যখন এই প্রত্যাশায় মুখিয়ে ছিলাম যে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট শিগগির তাদের সিনেটে খসড়া চুক্তিটি পেশ করবেন, তার কিছু পরই বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে সব লন্ডভন্ড করে দিল, খসড়া সিনেটে পেশ করার জন্য তারা উদ্যোগ তো নিলই না, বরং এ প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য যা কিছু সম্ভব তার সবই করল। সে বছরই অক্টোবর মাসে বিএনপির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমান এবং পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী ওয়াশিংটন গেলে রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রদূত তারিক করিম সাহেব তাদের এবং হ্যারি মার্শালকে তার বাড়িতে নেমন্তন্য করলে, হ্যারি সাহেব রাষ্ট্রদূত তারিক করিমকে এক কোনায় ডেকে নিয়ে গোপনে বললেন, “কই তোমার দেশের সরকার তো খসড়া চুক্তি সিনেটে পাঠানোর বিষয়ে আমাদের কিছুই বলছে না, বরং মনে হচ্ছে তারা এটি সিনেটে পাঠানোর বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে।” রাষ্ট্রদূত তারিক করিম সাহেব হয়ে পড়েছিলেন নির্বাক। এরপর অবশ্য করিম সাহেব আর বেশিদিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত থাকতে পারেননি। মার্শাল সাহেব তারিক করিম সাহেবকে আরও বলেছিলেন যে সিনেট এই খসড়া চুক্তি অনুমোদনের পক্ষেই রয়েছে, কেননা সিনেটররা আলোচনার ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। এই চুক্তিটি তখনই সিনেটের অনুমোদন পেয়ে কার্যকর হলে সেই সময়েই আমেরিকায় পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া সাজা কার্যকর করা সম্ভব হতে পারত। কিন্তু বিএনপি সরকার এতে বাদ সেধে পুরো প্রক্রিয়াটি নস্যাৎ করে দিয়েছিল যাতে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা খুনিদের বাংলাদেশে ফেরত আনা না যায়। অতীতে বিএনপি সরকারের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যেভাবে ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে এসব খুনিকে রক্ষা করার অপচেষ্টা করেছিল, একইভাবে জিয়ার স্ত্রীর নেতৃত্বের সরকারও এমন ব্যবস্থা করেছিল যাতে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরত আনা না যায়। কারণ একটিই যা হলো বঙ্গবন্ধু খুনের মূল হোতা তো ছিলেন স্বয়ং জিয়াউর রহমানই। তাই বন্দুকধারী খুনিদের রক্ষা করার দায়িত্ব তো তার এবং পরবর্তীতে তার স্ত্রীর ওপরই ছিল। আমেরিকার সঙ্গে উভয় দেশের কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরযুক্ত খসড়া চুক্তিটি মার্কিন সিনেটে পাঠানোর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিএনপি সরকার যা করেছিল তা এক কথায় রাষ্ট্রবিরোধিতারই শামিল, কেননা চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলকরই হতো।  এটি সত্য যে বহু দেশের এক্সট্রাডিশন আইনের মতো যুক্তরাষ্ট্রের আইনেও এমন কোনো দেশে আসামি হস্তান্তরের ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে, যে দেশে আসামির মৃত্যুদন্ড হতে পারে। কিন্তু এই বিধানটিও আলোচনার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর