সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

কাছ থেকে দেখা জাতির পিতা

ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও’।

কাছ থেকে দেখা জাতির পিতা

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন আর স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। বারবার তৈরি হয়েছে ফাঁসির মঞ্চ। সেই তিনিই এক সময় দেশকে শোষণমুক্ত করলেন। স্বাধীনতার তৃপ্ত হাসি এনে দিলেন সব থেকেও সব হারানো কয়েক কোটি মানুষের মুখে। তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনিই আমাদের জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আজ ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর ৪৭তম শাহাদাতবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৬ সালে। তারিখ ৮ এপ্রিল। ছয় দফার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারণায় এদিন পাবনা টাউন হলে আয়োজিত একটি জনসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন তিনি। যতদূর দেখেছি ও জেনেছি- ছয় দফাকে স্বাধীনতার সিঁড়ি ভাবতেন জাতির জনক। বলতেন, ‘ছয় দফায় যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’ অধিকার আদায়ের এ চিন্তা থেকেই ছয় দফার আন্দোলন দেশব্যাপী প্রচার করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। সেই ধারাবাহিকতায় পাবনায় (টাউন হল) সমাবেশ করতে আসা। তার আগে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও আমার চাচা আবদুর রব বগা মিয়ার বাসায় দুপুরের খাবার খেলেন। সেখানেই জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গেলাম। বিশেষ সাক্ষাতের সুযোগ হলো। বগা চাচা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী এম মনসুর আলী, এম এইচ কামারুজ্জামানসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ আদরের ‘তুই’ সম্বোধন করে বেশ কিছু দিক-নির্দেশনা দিলেন। সর্বশেষ বললেন- ‘মাঠে (জনসভার ময়দান) আয়।’ সদ্য এসএসসি পাস করেছি, পরিচয়ে তখনো কলেজের তকমা পাইনি। রাজনীতির কতটুকুই বা বুঝি? কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি দীর্ঘদেহী এই মানুষটির স্নেহমাখা ‘মাঠে আয়’ স্বরে কী যেন লুকিয়ে ছিল। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম- কেউ না নিলেও একাই যাব। কিন্তু সেটি আর করতে হলো না। সবার সঙ্গেই টাউন হলের জনসভায় গেলাম। বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তৃতা শুনলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, মনের অজান্তেই মুগ্ধ শ্রোতা থেকে গগনবিদারী স্লোগানদাতা হয়ে গেছি। মাধ্যমিকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলাম। কিন্তু ঘণ্টা খানেকের ব্যবধানে আমি যেন তাঁর ছাত্রলীগের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। সেই সক্রিয় প্রবেশ কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর ‘মাঠে আয়’ নির্দেশের মধ্য দিয়ে ঘটল। মূলত রাজনীতিতে আমার সক্রিয় ভাবটা ওই মুহূর্ত থেকেই। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। কয়েক মিনিটের সাক্ষাতে পিতা মুজিব যেভাবে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন; তাই যে পরবর্তীতে আমাকে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগের জিএস, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালনে উৎসাহ জুগিয়েছে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

পাবনার সেই ৮ এপ্রিল ১৯৬৬-এর পর বেশ কয়েকবার নাতিদীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তাঁর কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি। বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন ৪৫ বছর আগে। দীর্ঘ এই সময়ে স্বৈরশাসন, বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন এবং ওয়ান ইলেভেন এসেছে। রাজনৈতিক জীবনেও অনেক উত্থান-পতন দেখেছি, কত কিছু শিখেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে থাকার সেই মুহূর্তগুলো ভুলতে পারিনি।

বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে কাশিনাথপুর/নগরবাড়ীতে ‘মুজিববাঁধ’ উদ্বোধন করতে ১৯৭২ সালে আরেকবার পাবনায় আসেন জাতির জনক। আমি তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বভাবতই জনসভার স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল। বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন- ‘তুই তো ভালো বলিস’। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি; কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম জাতির পিতার দিকে। পরে দুই-একটি কথা বলে স্টেজের পাশে গেলাম। পরে এই ভেবে আনন্দিত হলাম যে, মাত্র ১৮ মিনিট বক্তৃতায় যিনি ৭ কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন তা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়। বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন- ঢাকা যাব কি না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তাও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামল পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও’।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর