১১ নভেম্বর, ২০২০ ১৪:১৯

দখলে বিহার, বিজেপির পরবর্তী লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ জয়

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

দখলে বিহার, বিজেপির পরবর্তী লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ জয়

বিহার জয়ে বিজেপির উচ্ছ্বাস

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বিহার জয় শেষ। রাজ্যটির ২৪৩ আসনের মধ্যে (ম্যাজিক ফিগার ১২২) এনডিএ জোট পেয়েছে ১২৫টি আসন। এর মধ্যে বিজেপির একার দখলেই গেছে ৭৪টি। এবার বিজেপির লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ জয়।
 
গত সপ্তাহেই পশ্চিমবঙ্গে দুই দিনের সফরে এসে বাংলায় ২০০ আসনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির সাবেক সভাপতি অমিত শাহ। এরপর মঙ্গলবার বিহার ভোটের ফল ঘোষণার দিনই বিজেপি নেতাদের একাংশের কথায় ধরা পড়েছে বাংলায় বাড়তি আত্মবিশ্বাসের সুর।
 
কিন্তু প্রতিবেশী বিহারের ফলাফলের প্রভাব কি পশ্চিমবঙ্গে পড়বে? এই প্রশ্ন ঘুরপাক করছে রাজনৈতিক মহলের আনাচে-কানাচে। বিশ্লেষকদের একাংশের অভিমত সামগ্রিকভাবে বলাই যায় যে বিহারের ফলাফল পশ্চিমবঙ্গে একুশের নির্বাচনেও বিজেপিকে বাড়তি প্রেরণা জোগাবে। বিহারের ফল দেখার পর তারা আরও কোমর বেঁধে বাংলা দখলের লড়াইয়ে ঝাঁপাবে।
 
পর্যবেক্ষকদের মতে বিহার ভোটের সবথেকে বেশি প্রভাব পড়তে পারে বিহার সীমান্ত লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিতে। উত্তরবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলাটি বিহার সীমানা লাগোয়া। গত লোকসভা ভোটে এই জেলার রায়গঞ্জ লোকসভা আসনে বিজেপি জিতেছে। পাশের দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট লোকসভা আসনটিও বিজেপির দখলে যায়। 
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় একাধিকবার বাংলায় প্রচারণায় এসেছিলেন মোদি। হাতেনাতে তার ফলও মিলেছে। রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৮টি জয় পেয়েছে তারা। আর এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলা জয়ই যে তাদের প্রধান লক্ষ্য-তা নিয়ে রাখঢাক করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি সভাপতি জয়প্রকাশ নাড্ডা বা সহ-সভাপতি মুকুল রায় বা সাংসদ দিলীপ ঘোষের মতো শীর্ষ নেতারাও। করোনার আবহে ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিজেপি নেতা-কর্মীদের সাথে ভার্চুয়াল সভা করে ফেলেছেন মোদি-অমিত শাহরা। গত মাসেই উত্তরবঙ্গ সফরে এসেছিলেন জে.পি.নাড্ডা। আর চলতি মাসের গোড়ার দিকে কলকাতাসহ দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জায়গায় আসেন অমিত শাহ। তবে নাড্ডা বা অমিত শাহ নয় একুশের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির অন্যতম ভোট অস্ত্র হতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি। তার বড় উদাহরণ বিহারে মোদি ম্যাজিক।
 
পশ্চিমবঙ্গ জয়ের ব্যাপারে বিজেপির অন্যতম কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয় বর্গীয় জানান ‘আমরা একশ শতাংশ জিতবো। গোটা দেশেই এখন মোদি ম্যাজিক চলছে। বাংলাতেও আমরা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবো। খুবই সহজ ব্যাপার। হতে পারে আমরা ২২০টি আসনেও জিততে পারি।’ তার অভিমত ‘ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতি মানুষের অনেক ভালোবাসা রয়েছে, আর মমতা ব্যানার্জির সরকারের ওপর তাদের অনেক ক্ষোভ জন্মেছে।’
 
তবে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের অবশ্য দাবি বাংলায় বিজেপি কোনভাবেই ছাপ ফেলতে পারবে না। দলের লোকসভার সিনিয়র সাংসদ সৌগত রায় জানান ‘বাংলায় ওদের (বিজেপি) জয় কোনদিনই হবে না। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসেই জিতবে এবং ভালোভাবে জিতবে। এটা নির্বাচনের ৬ মাস আগেই আমি বলে দিচ্ছি।’
 
পর্যবেক্ষকের আরেকটি অংশের অভিমত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির লড়াই অত্যন্ত কঠিন হতে চলেছে। বিহারে এনডিএ জোটের বিরুদ্ধে ছিল আরজেডি-কংগ্রেস-বামেদের মহাজোট। কিন্তু তা সত্বেও মোদি-নীতিশ কুমারের মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদরা বিরুদ্ধে কার্যত একাই ময়দান কাঁপিয়েছে আরজেডি নেতা লালু প্রসাদ যাদবের ছোট ছেলে তেজস্বী যাদব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির টক্কর তুলনামূলক ভাবে অনেক শক্ত প্রতিপক্ষ মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে।  
এছাড়াও আছে মুসলিম ভোট এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) এর মতো বিতর্কিত ইস্যুগুলি। প্রতিবেশি বাংলাদেশের সাথে একটা বিশাল অংশের সীমান্ত রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের। কিন্তু সিএএ ও এনআরসি ইস্যুতে গতবছরের শেষ দিকে উত্তাল হয়ে ওঠে ভারত এবং তাতে প্রতিবেশি বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়ে।
 
এর পাশাপাশি আরেকটি দিক আছে যেটা বিজেপির চিন্তার কারণ হতে পারে-তা হল বিহারী ভোট। আদতে বিহারী হলেও কয়েক প্রজন্ম ধরে তারা এরাজ্যে বসবাস করে আসছেন। যারা বাংলাকেই তাদের ঘর বলে মনে করে থাকেন। এদের একটা বিশাল অংশ বিজেপি সমর্থক বলেই পরিচিত। যদিও একটা সময় এরাই ছিল বামেদের ভোটব্যাঙ্ক, পরে তাতে থাবা বসায় তৃণমূল। কিন্তু সাম্প্রতিক দলিত ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ কয়েকটি কারণে বিজেপি বিরোধী মুখ হয়ে উঠেছে এই বিহারীরা। আর সর্বোপরি রয়েছে বাংলায় বিজেপির নেতৃত্বের অভাব। বলতে কোন দ্বিধা নেই মমতা ব্যনার্জিকে টক্কর দেওয়ার মতো বাংলায় কোন জনপ্রিয় নেতা নেই বিজেপির।
 
তবে এতগুলি শক্ত গাঁট থাকলেও বিজেপির প্লাস পয়েন্ট হতে পারে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (এআইএমআইএম) এর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা। মঙ্গলবার বিহার নির্বাচনে তার দল ভাল ফল করার পরই দলের সাংসদ ও সভাপতি আসাদুদ্দিন ওয়েইসি জানান, আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গে প্রার্থী দেবে তার দল। প্রতিনিয়ত সিএএ বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে এই দলটি। মূলত সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক বলেই আসাদুদ্দিনের দলকে চেনে রাজনৈতিক মহল। রাজ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গে তার দল প্রার্থী দিলে তা মমতার সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্কেই থাবা বসাবে। যা আখেরে লাভ হবে বিজেপির। আর সেটা আঁচ করে আসাদুদ্দিনকে ইতিমধ্যেই তোপ দেগেছেন তৃণমূল নেত্রী।
 
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স’এর অধ্যাপক সুমন্ত্র বসু জানান, বাংলায় বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছে মমতা ব্যানার্জি। তিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতি করছেন। বহু লড়াই, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছেন। তাই তেজস্বী যাদবের মতো একজন তরুণ রাজনীতিবিদ বিহারে যেভাবে লড়াই দিয়েছে সেখানে বাংলায় মমতা ব্যানার্জিকে পরাস্ত করাটা বিজেপির পক্ষে মোটেই সহজ হবে না।
 
তাছাড়া বিহারের নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হলেও সেখানে আশানরূপ ফল করেছে বাম দলগুলি। ফলে বাংলার বাম-কংগ্রেস নেতারা একুশের লড়াইয়ে তাদের জোটের ফল নিয়ে আশাবাদী হতেই পারেন।
 
পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সাংসদ ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর রঞ্জন চৌধুরী জানান, বিহারের নির্বাচন চলাকালীন কংগ্রেস বা বাম দলগুলোর কর্মীদের কাছে খুব ভালো বার্তা গেছে যে বিহারে লালু প্রসাদ যাদব-কে জেলে রেখেও তার ছেলে তেজস্বী যাদবকে আটকাতে পাচ্ছে না, যেখানে তেজস্বী-কে হারাতে প্রধানমন্ত্রীকেও ময়দানে নামতে হচ্ছে তবে আমরা কেন এ রাজ্যে সেটা পারব না। তাই এই বিষয়টি বাংলার নির্বাচনেও অবশ্যই সদর্থক প্রভাব ফেলবে।
 
সিপিআইএম নেতা শমীক লাহিড়ী জানান, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চায় এখানে শিল্প-কারখানা হোক। আর সেটা বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিই পারবে। এছাড়া রাজ্যে দালাল মুক্ত বাজার বা শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের অবসান-সেটাও বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিই পারবে। ফলে পশ্চিমবঙ্গেও বিকল্পের সন্ধানে যে লড়াই তা আরো উৎসাহিত হবে বিহারের এই ফলাফলে মধ্যে দিয়ে।
 
বিহারে যা হওয়ার হয়ে গেছে এবার পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচনে কি হবে সেদিকেই আপাতত নজর সকলের।
 
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর