রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

প্রতারণার শত ফাঁদ

প্রতারণার শত ফাঁদ

প্রতারণার নানা ফাঁদের জালে ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষ। চলতি পথের পদে পদে শতেক প্রতারণার বেড়াজাল। ঘরে বসে থাকলেও রেহাই নেই। হরেক কৌশলের ফাঁদে পড়ে খোয়াতে হয় সঞ্চয়ের টাকা। প্রতারণার এই ভয়াবহতার শিকড়-বাকড় ব্যক্তি-পরিবার থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে। নানা স্টাইলের প্রতারণার জাল বিছিয়ে বিভিন্ন চক্র হাজারো মানুষকে প্রতিনিয়ত প্রতারিত করে আসছে।
ডিজিটাল জীবন ব্যবস্থাপনায় 'প্রতারণাও' ডিজিটাল রূপ পেতে শুরু করেছে। এখন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড যেমন জালিয়াতি করে যে কারও অ্যাকাউন্ট খালি করা হচ্ছে, তেমনি গলা কাটা পাসপোর্ট তৈরি, বিদেশ থেকে ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ, নিয়োগপত্র প্রস্তুত, মোবাইল ফোনে লাখ লাখ টাকা লটারি পাওয়ার প্রলোভনযুক্ত মেসেজ বানিয়েও প্রতারণা চলছে হরদম।
টাউটদের নানা বুদ্ধির কৌশলী ফাঁদে শুধু যে গ্রামের সহজ-সরল, অজ্ঞ-অসচেতন মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, শহুরে শিক্ষিত সচেতন বাসিন্দারাও এসব প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে চলছে অহরহ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে প্রতারণার হরেক চিত্র। রাস্তাঘাটের যেখানে সেখানে দেখা যায় পার্টটাইম চাকরির বিজ্ঞাপন। এসব লোভনীয় চাকরির বিজ্ঞাপনের পাতা ফাঁদে পা দিলেই বিপদ। শুধু রাস্তার বিজ্ঞাপন কেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও চাকরি দেওয়ার নামে অহরহ প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। ইমিগ্রান্ট ভিসা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে অনেককে। সরকারি বিভিন্ন দফতর-অধিদফতরে লোভনীয় চাকরি দেওয়ার নামে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের তৎপরতা চলছে দেশজুড়েই। সাম্প্রতিক সময়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে চক্রটির কয়েকজন সদস্য গ্রেফতার হতেই বেরিয়ে আসে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর কাহিনী। সেনাবাহিনী, খাদ্য অধিদফতর, বিজিবি, কাস্টমস বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার নামে দেওয়া ভুয়া নিয়োগপত্র হাতে নিয়ে বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে শত শত লোক চাকরিতে যোগদানের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যাগ, পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে ঢাকায় হাজির হয়। নিয়োগপত্র অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দফতরের চাকরিতে তারা যোগদান করতে গেলে প্রতারণার বিষয়টি ফাঁস হয়। কিন্তু ততক্ষণে মাথাপিছু ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা। বিভিন্ন ম্যারেজ মিডিয়ার সহযোগিতায় প্রতারণার নতুন ফাঁদ খুলে বসেছে রাজধানীর কিছুসংখ্যক তরুণীর সংঘবদ্ধ চক্র। রেন্ট-এ-কারের কাগজপত্রহীন প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস ভাড়ায় নিয়ে বিক্রি করে দেওয়ার আরেকটি প্রভাবশালী চক্র গজিয়ে উঠেছে বাড্ডা-গুলশান এলাকায়। রূপসী এক তরুণীর নেতৃত্বে গজিয়ে ওঠা চক্রটির কয়েকজন ডিবির হাতে ধরা পড়লেও তাদের অপতৎপরতা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এখনো।
প্রতারণার আগ্রাসী থাবার সামনে প্রেমও আর নির্বিঘ্ন থাকছে না। ফেসবুকে প্রেমের ছলনায়ও হরেক রকমের প্রতারণা বাণিজ্য চলছে ধুমছে। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে আট মাসেরও বেশি সময় ধরে সোহেল মাহমুদ নামে এক তরুণ রামপুরার এক কলেজছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রথম দেখার দিনই মোটরসাইকেল কেনার নামে প্রেমিকাকে নিয়ে সোহেল মগবাজারের একটি শোরুমে যায়। সেখানে তরুণীটির পছন্দে নতুন মোটরসাইকেল কেনার উদ্যোগ নেয় সে। একপর্যায়ে প্রেমিকাকে শোরুমে বসিয়ে মোটরসাইকেল ট্রায়াল দেওয়ার নামে দ্রুতগতিতে চালিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় প্রেমিকরূপী সোহেল মাহমুদ। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও আর ফিরে না এলে শোরুমের মালিক তরুণীটির বাবা-ভাইকে ডেকে এনে মোটরসাইকেলের দাম আদায় করে তবেই তাকে ছাড়েন। ভুয়া মসজিদ-মাদ্রাসার নামে টাকা তোলে একদল প্রতারক। তাদের কাছে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড মুখ্য বিষয় নয়। এগুলো টাকা, দান, হাদিয়া বা দক্ষিণা তোলার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার যুগেও সর্বরোগের মহৌষধ বিক্রির নামে মহানগরজুড়ে চলছে সীমাহীন প্রতারণা। রাজধানীর রাস্তা-ফুটপাত, মোড়, বাজার, ট্রেন স্টেশন, লঞ্চ ও বাস টার্মিনালসহ দেড় শতাধিক স্থায়ী স্পট রয়েছে ওষুধ ফেরিওয়ালাদের। যেখানে-সেখানে বসে পাখির ঠোঁটে ভাগ্য গণনার আসর, সাপুড়েদের তাবিজ বিক্রির মহড়া, কঙ্কাল আর শিকড়-বাকড় নিয়ে আদি অকৃত্রিম গলায় কিংবা টু-ইন-ওয়ানের বর্ণনা দিয়ে চলে বিচিত্র সব ক্যানভাসার। তাদের ভাষায়, নিজ হাতে প্রস্তুতকৃত ওষুধ বিভিন্ন প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধির 'অব্যর্থ মহৌষধ'। বেআইনিভাবে ফেরি করে বিক্রি করা তথাকথিত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ব্যবহারে রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে তা আরও জটিল হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। হাতুড়ে ডাক্তার ও লতাগুল্মের ভুয়া কবিরাজে সয়লাব হয়ে আছে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বত্র। জাদুটোনা দিয়ে শত্রুকে বশে আনা, অন্যের স্ত্রী বশীকরণ, মনের মানুষকে পাওয়ার অব্যর্থ কবচ_ এমনকি অপারেশন না করে ঝাড়-ফুঁক দিয়েই পেটের পাথর অপসারণ করার মতো কামেল লোকের ছড়াছড়ি আছে পত্রিকার বিজ্ঞাপনে। দয়াল পাগল চেংরা বাবার দুই চোখের ইশারায় চাকরি, অসচ্ছলতা দূর, হারানো ব্যক্তিকে ফিরে পাওয়া, দাম্পত্য কলহ মিটমাটসহ সব মুশকিলই কেটে যায়। এ ছাড়া যে কোনো অঙ্কের টাকা বাবার হাতে তুলে দিলে তা আগুনে পোড়ালেই দ্বিগুন হয়ে যায়। এমন লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে রাজধানীর শান্তিবাগে প্রতারণার নতুন ফাঁদ পেতেছে এলাকার একটি দুষ্ট চক্র।
ইদানীং ক্যানভাসাররা সংঘবদ্ধভাবেও প্রতারণা শুরু করেছে। অভিজাত মার্কেটে অফিস সাজিয়ে বসে তার দালালদের মাধ্যমে রোগী ধরে বিভিন্ন হাসপাতাল গেট ও সংলগ্ন রেস্টুরেন্টগুলোয় সার্বক্ষণিক বিচরণ থাকে দালালদের। তারা নানা কথার ছলে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর আত্দীয়স্বজনকে ফুসলিয়ে নিজের অফিসে আনে এবং মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তথাকথিত 'মহৌষধী চিকিৎসা' শুরু করে। চারদিক দিয়ে 'প্রতারকমণ্ডলী' দ্বারা পরিবেষ্টিত পুরো সমাজব্যবস্থাই যেন প্রতারণাময় হয়ে উঠেছে। দেড় দশক ধরে বিদেশে উচ্চশিক্ষার নামে একধরনের প্রতারণা মহামারী রূপে দেখা দিয়েছে। দেয়াললিখন, পত্রিকা, পোস্টার ছেয়ে আছে এসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। সঠিক তথ্য জানা না থাকায় অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এসব প্রতিষ্ঠানে। ভদ্রবেশী প্রতারকদের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিয়ে হাজারো তরুণের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন এখন বিবর্ণর্ হয়ে গেছে। রাতে রাজধানীজুড়ে পুলিশ সোর্স পরিচয়ধারীদের ভয়ঙ্কর প্রতারণার জালে পড়ে শত শত মানুষের ভোগান্তির ঘটনা না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই। নগরীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে টহল পুলিশ ছাড়াও বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্টের আদলে নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়। সেসব স্থানে রাতভর পুলিশকে সহায়তা দেওয়ার নামে সোর্স পরিচয়ে চিহ্নিত যুবকদের আনাগোনা থাকে। তারা রিকশাযাত্রী বা নিরীহ পথচারীর দেহ তল্লাশির নামে আশপাশে নিয়ে পকেট-মানিব্যাগ হাতড়াতে থাকে। একপর্যায়ে নিজেদের আঙ্গুলের চিপায় ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকিয়ে তা ভুক্তভোগীর পকেট থেকে উদ্ধার করা দেখায়। শুরু হয় দরকষাকষি, হৈচৈ, চড়থাপ্পড়। চাহিদামাফিক অর্থ আদায়ের পরই ভুক্তভোগীরা ছাড়া পায় বলে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
ঈদ-পার্বণ এলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানামুখী প্রতারক আরও তৎপর হয়ে ওঠে। থুথু পার্টি, ধাক্কা পার্টি ও অজ্ঞান পার্টির দুর্বৃত্তরা নানা কায়দায় টাকা-পয়সা লুটে নেয়। মওকা পেলেই চড়াও হয় শিকারির ওপর। হাতিয়ে নেয় টাকা-পয়সা, হাতব্যাগসহ মূল্যবান সম্পদ যা কিছু পায়। বায়তুল মোকাররম ও সংলগ্ন মার্কেটগুলোর আশপাশে থুথু পার্টির সদস্যরা তৎপর ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। এ চক্রের সদস্যরা প্রথমে কাউকে টার্গেট করে এবং তার শরীরেই থুথু ছিটিয়ে দেয়। এ নিয়ে বাদানুবাদের একপর্যায়ে নিরীহ পথচারীর ওপর চক্রের সদস্যরা হামলা চালায় এবং টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। মহাখালীতে আছে ধাক্কা পার্টির দৌরাত্দ্য। তাদের কবলে নতুন মুখের মানুষ সীমাহীন বিপদগ্রস্ত হয়। ছিনতাইকারী আলেকের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ চক্র পথচলা মানুষের গায়ে খামোখা ধাক্কা মারে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে কারও দেহের ওপর। শুরু হয় বাদানুবাদ, হাতাহাতি। এরই মধ্যে চক্রের অন্য সদস্যরা ঘিরে ধরে সংশ্লিষ্ট পথচারীকে নির্জন গলিতে নিয়ে সবকিছু লুটে নেয়। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে ওঠে অজ্ঞান পর্টি। দূরপাল্লার যাত্রীদের খাবারের সঙ্গে কৌশলে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ঘুমের ওষুধ সেবন করায় একটি চক্র। কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রীটি অজ্ঞান হয়ে পড়লে ওই চক্রের সদস্যরা তার টাকা-পয়সা, ব্যাগেজ_ সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়ে।

Back to convert page

সর্বশেষ খবর