রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

টোকাই যখন কোটিপতি

টোকাই যখন কোটিপতি

রাজধানীর বনানী থানার দুটি বস্তি যেন টাকার কারখানা। বনানীর কড়াইল ও মহাখালীর সাততলা বস্তির নোংরা, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে সাড়ে চার লাখ মানুষের মানবেতর জীবন কাটে। কড়াইল ও সাততলা বস্তিতে রাষ্ট্রীয় গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানি চুরি করে মাত্র ১০ বছরেই অর্ধ শতাধিক ব্যক্তি কোটিপতি হয়েছেন। মাত্র ৫-৬ বছর আগেও তাদের অনেকেই 'বস্তির টোকাই' ছিলেন। কারও কারও পরিচিতি ছিল গাড়ি চলাচলের রুট নম্বরের নামে। গুলশান-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী ৬ নম্বর লোকাল বাসের হেলপার থাকায় আবু সাঈদ বাবুর নাম-পরিচয় ছিল '৬ নম্বরী বাবু' হিসেবে। অল্পদিনের ব্যবধানে সেই ৬ নম্বরী বাবুও এখন ২০-২২ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। লেটেস্ট মডেলের চার চারটি গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি। 
কড়াইল বস্তির আরেক টোকাই নৌকা চালাতে চালাতেই যিনি 'মৈনা মাঝি' নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ চুরি করে তা কড়াইল বস্তিতে সরবরাহ দিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন টাকার কুমির। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে সেই মৈনা মাঝি এখন ডাকসাইটে ঠিকাদার, নাম পাল্টে হয়েছেন চৌধুরী মনিরুল ইসলাম (মনা)। বিদ্যুৎ বিভাগের (পিডিবি) তালিকাভুক্ত ১ম শ্রেণীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে দুটি লাইসেন্স আছে তার। ৬ নম্বরী বাবু আর মৈনা মাঝির চেয়েও অবিশ্বাস্য উত্থান ঘটেছে হোটেল বয় মোমিনের। কড়াইল বস্তিতেই রিকশা চালকদের জন্য রমিজের বানানো পলিথিন ছাউনির ভাতের হোটেলে পানি সরবরাহকারী বয় হিসেবে কাজ করত মোমিন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত পেটে ভাতে থাকলেও পরবর্তীতে মোমিনকে মাসে ৪০০ টাকা করে বেতন দেওয়া হতো। একপর্যায়ে 'বস্তির রাজা' খ্যাত মোশাররফ হোসেন মশা'র গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি চুরির সিন্ডিকেটে যোগ দেয় সে। এরপর মোমিনকে পিছু তাকাতে হয়নি।
কোটিপতি হওয়ার পথে : কড়াইল মোশারফ পট্টির স্যাটেলাইট বস্তিটি দেখাশোনা ও চাঁদা আদায়ের দায়িত্ব পালন করতেন মোশাররফ হোসেন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। পুরো বস্তি এলাকা ঘিরে ছিল মোশাররফ ও তার বাহিনীর একচ্ছত্র দাপট। কিন্তু প্রতিপক্ষ গ্রুপের ক্যাডাররা মোশাররফকে খুন করে তার সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। মোশাররফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি আবু সাঈদ বাবু ওরফে ৬ নম্বর বাবু এখন মোশাররফ সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি। তারই ভাই শহীদুল ও আরিফ এবং তাদের সহযোগীরা মোশাররফ পট্টির যাবতীয় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। কড়াইলের বেলতলা বস্তিসহ আশপাশের কয়েকটি পট্টি নিয়ন্ত্রণ করছে 'দস্যুরানী ফুলনদেবী' খ্যাত তাছলি ও তার স্বামী মোস্তফা। তার বস্তিপাড়ায় হরদম আড্ডা বসে আনন্দ ফুর্তির। তাছলির 'হেরেমখানায়' বনানী থানার অনেক কর্মকর্তার নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। ফলে তাছলির আনন্দ আয়োজনের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। কড়াইল বস্তির আরেকটি অংশের নিয়ন্ত্রণ করছে থানার তালিকাভুক্ত আরেক সন্ত্রাসী শফিকুল ইসলাম ও তার বড় ভাই রিপন। টিএন্ডটির রফিক ড্রাইভারের ছেলে শফিক-রিপন রীতিমতো কড়াইলবাসীর 'যমদূত'। 
কড়াইল বস্তির গুলশান অংশের নিয়ন্ত্রণ করেন সেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা। আরেক অংশের নিয়ন্ত্রক ছিলেন টোকাই মোমিন। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বাণিজ্য করেই এক সময়ের হোটেল বয় মোমিন এখন কোটিপতি। মোমিনের মতো আরও শতাধিক ছিন্নমূল টোকাই শুধু কড়াইল বস্তির নানা অবৈধ বাণিজ্যকে পুঁজি করে শত কোটি টাকার মালিক। কড়াইল ও সাততলা বস্তির উপার্জনক্ষম পুরুষ বাসিন্দারা বেশিরভাগই দিনমজুর, হকার, ফেরিওয়ালা বা রিকশা-ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। নারীরা বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ, নয়তো রাস্তায় ইট ভাঙার কাজ করেন। কেউ কেউ বড়জোর গার্মেন্ট কর্মীতে উন্নীত হয়েছেন। তবে বস্তির বেশিরভাগ বাসিন্দাই বেকার, ঘরে ঘরে চরম অভাব। অথচ এসব বিপন্ন মানুষকে পুঁজি করে প্রতি বছরই ৮-১০ জন লোক অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে উঠেন। মাত্র দুই-তিন বছরেই সিন্ডিকেট সদস্যরা নাম লেখান ক্রোড়পতির তালিকায়। বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা, পার্টির নেতৃত্ব, ক্ষমতার দাপট কোনো কিছুরই অভাব থাকে না তাদের। টোকাইদের কোটিপতি হওয়ার নেপথ্য কাহিনী বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে।
গ্যাস-বিদ্যুতের হরিলুট: কড়াইল বস্তিতে ৪০ হাজারেরও বেশি পরিবারে তিন লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। চার দশকের এ বস্তিতে কখনো গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ওয়াসার কোনো সংযোগ দেওয়া ছিল না। কিন্তু বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সংযোগহীন একটি ঘরের অস্তিত্ব কখনই ছিল না সেখানে। সব ঘরেই চোরাইভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দেওয়া রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। বস্তিবাসীরা জানান, প্রতি চুলার জন্য সংঘবদ্ধচক্র এককালীন দুই হাজার টাকা করে নিয়েছে। এখন মাসে মাসে আদায় করে নেয় ৫০০ টাকা করে। বস্তিবাসী আরও জানায়, শুধু বস্তিতে নয়, বিপজ্জনক পদ্ধতিতে প্লাস্টিক পাইপের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি হোটেল রেস্তোরাঁতেও সংযোগ দেওয়া হয়েছে। চোরাইভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়া একেকটি হোটেল থেকে প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। এভাবে কড়াইলের চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা শুধু গ্যাসের চোরাই সংযোগ দিয়েই প্রতি মাসে আদায় করে অন্তত ১২ কোটি টাকা। আদায়কৃত টাকার আড়াই কোটি টাকা প্রতি মাসে উপঢৌকন হিসেবে পাচ্ছেন গ্যাস কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কড়াইল গুদারাঘাট ঘেঁষা পুলিশ বঙ্টির ঠিক পাশেই রংবেরংয়ের বেশ কয়েকটি পাইপ মাটি ফুড়ে বের করা আছে। সেসব পাইপ সোজা চলে গেছে লেকের পানির ভেতর দিয়ে ওপারের কড়াইলে। এগুলো বিপজ্জনক গ্যাস সরবরাহের হাতুড়ে পদ্ধতি। অবৈধ গ্যাস বাণিজ্য পরিচালনা করছে মিজান ও শামসু নামের দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি চক্র। তবে মিজান দাবি করেছেন, গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তিতাস কর্মকর্তা নওশাদ ইসলামের দাবি, এর আগেও তারা এ ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। কিন্তু এরপরও আবার সংযোগ নেওয়া হচ্ছে। গুলশান ১ নম্বর গোল চক্করের অদূরে ভাসাবি ভবনের পাশ থেকেই বাঁশের খুঁটির সাহায্যে লেকের মধ্য দিয়েই বস্তিতে চলে গেছে বিদ্যুতের চোরাই লাইন। লেকের পানিতে পুঁতে রাখা বাঁশ খুঁটিগুলোর কোনোটি বিপজ্জনকভাবে হেলে রয়েছে। ঝুলে থাকা তারের নিচ দিয়েই রাত দিন বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে নৌকা চলাচল করে। অবৈধভাবে নেওয়া এসব ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ দেওয়া হয় প্রতি বাল্ব মাসে ১২০ টাকায়। এভাবে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ সংযোগের খাত থেকে ১৫-১৬ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেয় সংঘবদ্ধ চক্রটি। 
সাততলা বস্তি : মহাখালীর সাততলা বস্তিটির দুটি ভাগ। এর মধ্যে নামাপাড়া বস্তিতে ৫ হাজার পরিবারে ২৫ হাজার লোকের বাস। অন্যটি আইপিএইচ বস্তি- সেখানে সাড়ে তিন হাজার পরিবারে ১৫ সহস্রাধিক নিম্ন আয়ের মানুষ বসতি গড়ে তুলেছে। সাততলার নামাপাড়া বস্তিতে চোরাই গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ প্রদানসহ বিলের নামে মাসিক চাঁদা আদায়কারী সিন্ডিকেটে রয়েছে, হাসানউজ্জামান, গ্যাস মানিক, জাকির, দাদা খালেক, সাদ্দাম, ওমর ফারুক কেরু, জামাই নাজিমসহ ১২-১৩ জনের নাম। ডেসা তেজগাঁও কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ওই সিন্ডিকেটের অঘোষিত উপদেষ্টা। সুলতান, রতন, নূরু, ঢাকাইয়া শামীম, ড্রাইভার বেল্লাল, নূরুল ইসলাম, লেংড়া জলিল, মোতালেব, সোহেল এবং তাদের আরও ৭-৮ সহযোগী। এখানকার চাঁদাবাজি থেকে বনানী থানা পুলিশের জন্য প্রতিদিন টাকা আদায় করেন হেভেন টেলিকমের শাহ আলম। তিনি থানা কালেক্টর হিসেবেই বেশি পরিচিত।

সর্বশেষ খবর