বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

টালমাটাল স্বর্ণের বাজার বাড়ছে পাচার

টালমাটাল স্বর্ণের বাজার বাড়ছে পাচার

স্বর্ণের বাজার টালমাটাল হয়ে উঠেছে। বছরজুড়ে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে নিয়মিত সোনার দাম কমছে। পাশাপাশি বাড়ছে পাচার। পাচার হয়ে আসা সোনার ধরা পড়া অংশ দিয়ে রিজার্ভ বাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ নিয়ে গত ১১ মাসে সোনার দাম ভরিপ্রতি প্রায় ১০ হাজার টাকা কমেছে। গত জানুয়ারিতে প্রতি ভরির দাম ছিল ৫৮ হাজার ৩২০ টাকা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ভরিপ্রতি এক হাজার ১৬৭ টাকা কমে ২২ ক্যারেট সোনা ৪৮ হাজার ৪০৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এদিকে সোমবার চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ১৫ কেজি সোনা আটক হয়েছে দুবাই-ফেরত এক যাত্রীর কাছ থেকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে কেনা ১০ টনসহ পাচারকালে বিমানবন্দরে ধরা পড়া সোনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনার রিজার্ভ সাড়ে ১৩ হাজার কেজি ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে গত অক্টোবর পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া চোরাই সোনার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৪৩ কেজি।

দাম কমছেই : আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম কমার পাশাপাশি বৈশ্বিক চাহিদাও কমেছে। চলতি বছরের ১১ মাসে বিশ্বব্যাপী সোনার দাম পড়ে গেছে ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে সোনার বৈশ্বিক চাহিদা কমেছে ২১ শতাংশ। বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে সোনার চাহিদা এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ কমে হয় ৮৬৯ টন। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডবি্লউজিসি) জানায়, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সোনা আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ, পাশাপাশি বাণিজ্যিক সোনার চাহিদা কমায় বাজারে এ প্রভাব পড়েছে। এদিকে গত ১১ মাসে বাংলাদেশে সোনার দাম ভরিপ্রতি প্রায় ১০ হাজার টাকা কমেছে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সোনার দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে ভরিপ্রতি সর্বোচ্চ এক হাজার ১৬৭ টাকা পর্যন্ত কমেছে সোনার দাম। ফলে শুক্রবার থেকে প্রতি ভরির দাম দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৪০৫ টাকা। সমিতির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন ও দেশে চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নতুন দর অনুযায়ী, প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) ২২ ক্যারেট সোনা ৪৮ হাজার ৪০৫ টাকা, ২১ ক্যারেট ৪৬ হাজার ২৪৭ টাকা এবং ১৮ ক্যারেটের দাম হবে ৩৯ হাজার ৬৫৭ টাকা। এ ছাড়া সনাতন পদ্ধতির সোনার দাম কমে ২৭ হাজার ৪১০ টাকা ভরি হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহতভাবে দরপতনের ফলে গত এপ্রিলে সোনার দাম দুই দফা কমে, বাড়ে এক দফা। মে মাসে এক দফা ও জুন মাসে দুই দফা সোনার দাম কমায় বাজুস। আগস্ট মাসে দুই দফা দাম বাড়ে। ১৪ সেপ্টেম্বর এক দফা দাম কমায় জুয়েলার্স সমিতি। বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন ও দেশে হরতালের কারণে বাজারে চাহিদা কম থাকায় সোনার দাম কমানো হয়েছে। তিনি বলেন, নভেম্বর ও ডিসেম্বর জুয়েলারি ব্যবসার পিকটাইম হলেও এবার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হরতাল-সহিংসতায় ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে।

বাড়ছে চোরাচালান : এদিকে দেশের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে সম্প্রতি সোনার চোরাচালান বেড়েছে। গত কয়েক মাসে শাহজালাল ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পাচারকালে নিয়মিতই সোনা ধরা পড়ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতের আমদানি কড়াকড়িতে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে সোনা পাচারের ঘটনাও ধরা পড়ছে। পাচারের একটি বড় অংশ ভারত চলে যাচ্ছে বলে সূত্র জানায়। সর্বশেষ সোমবার চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ১৫ কেজি সোনা আটক হয়েছে দুবাই-ফেরত এক যাত্রীর কাছ থেকে। এ নিয়ে শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে এ বছর ৯টি চালানে ৪০ কেজি সোনা আটক করেছে কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ। গত ২১ অক্টোবর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩২ কেজি সোনা আটক করে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন। এ চালানে ২৪০টি সোনার বার আটক করা হয়। বছরের সবচেয়ে আলোচিত সোনা আটকের ঘটনাটি ঘটে গত ২৪ জুলাই। শাহজালাল বিমানবন্দরে ১০৬৫টি সোনার বারে ১২৪ কেজি সোনা আটক করা হয়। গত ১ জানুয়ারি থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রায় ৩০০ কেজি সোনা আটক করে কাস্টমস ও পুলিশ। এর মধ্যে শুধু কাস্টমস কর্তৃপক্ষই ২০০ কেজির বেশি সোনা আটক করে। গত তিন বছরে তিন হাজার ৬০০-এর বেশি ব্যক্তিকে সোনা চোরাচালানের অভিযোগে বিমানবন্দর থেকে আটক করে কাস্টমস, সিভিল এভিয়েশন, ইমিগ্রেশন, এনএসআই ও পুলিশ সদস্যরা।

চোরাই সোনায় রিজার্ভ বাড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের : বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ১০ টন সোনা কেনে। এই কেনা সোনার সঙ্গে যোগ হচ্ছে পাচারকালে ধরা পড়া সোনা। সূত্র জানায়, চোরাই সোনায় বাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনার রিজার্ভের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসছে চোরাচালানকালে আটক হওয়া বিনামূল্যে পাওয়া সোনা থেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, চোরাচালানের সোনা আটকের পর পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়। এরপর আইন অনুযায়ী কেউ যদি এর প্রকৃত দাবিদার হয় তাকে ফেরত দেওয়া হয়। দাবিদার না থাকলে এটি সরকারের স্থায়ী সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনা বিক্রি করে সরকারের কোষাগারে অর্থ জমা দেয়। তবে চোরাচালানিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া সোনার দাবিদার সাধারণত পাওয়া যায় না।

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর সোনার রিজার্ভের বিপরীতেই টাকা ছাপাত বাংলাদেশ। এখন শুধু সোনা নয়, বৈদেশিক মুদ্রাতেও রিজার্ভ রাখছে বাংলাদেশ। তবে কেনা এবং আটক হওয়া সোনা মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বর্তমানে সোনা রিজার্ভ আছে ১৩ হাজার ৪৭ কেজি। এর মধ্যে ২০১২ সাল পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া চোরাই সোনার পরিমাণ এক হাজার ৮৪৩ কেজি। দেশের ইতিহাসে ২০১২ সালে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৩৮৬ কেজি চোরাই সোনা উদ্ধার হয়েছে। চলতি বছরের এ পর্যন্ত হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক হওয়া সোনার পরিমাণ ৩০০ কেজির বেশি। তবে ২০১৩ সালে এখন পর্যন্ত চোরাই সোনার কি পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা পড়েছে তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি।

 

 

সর্বশেষ খবর