বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা
ইতিহাসের খেরো খাতা - ৩

ভদকার গন্ধ বেরোচ্ছিল ইয়াহিয়ার মুখ থেকে

পাকিস্তানকে কেন ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন নিক্সন -কিসিঞ্জার। একাত্তরে কেমন ছিল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ভূমিকা। আন্তর্জাতিক জার্নাল থেকে অনুবাদ করেছেন মুজাহিদুল হক

ভদকার গন্ধ বেরোচ্ছিল ইয়াহিয়ার মুখ থেকে

নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। বঙ্গোপসাগর থেকে উৎপন্ন এক শক্তিশালী সাইক্লোন বয়ে যায় পূর্বাঞ্চলে। প্রাকৃতিক ওই দুর্যোগে নিহত হন শতসহস লোক। স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিসাব অনুযায়ী এতে নিহত হন পাঁচ লাখ লোক। এমন এক দুর্যোগের মুহূর্তেও ইয়াহিয়া সরকার ছিল নিষ্ক্রিয়। যদিও পূর্ণ সামরিক রাজপোশাকে জেনারেল ইয়াহিয়া পরিদর্শনে এলেন ধ্বংসস্তূপ। মুখ দিয়ে বেরোচ্ছিল ভদকার উৎকট গন্ধ। এসে বেশি সময় থাকলেন না। কয়েক ঘণ্টা পরই পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গেলেন জেনারেল। ঢাকায় তৎকালীন এক মার্কিন কূটনীতিকের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক গ্যারি জে বাস উল্লেখ করেন, 'সাইক্লোন ছিল দুই প্রদেশের মধ্যে চূড়ান্ত বিভক্তির প্রকৃত কারণ।' তিন সপ্তাহ পর যখন নির্বাচনে অংশ নিল পূর্ব পাকিস্তান, ফলাফল হলো অভূতপূর্ব। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল মুজিবের আওয়ামী লীগ। ভারসাম্য ফিরে এলো রাজনীতিতে। বিষয়টি হকচকিত করল জেনারেল ইয়াহিয়াকে। পূর্ব পাকিস্তান যে স্বাধীনতা চেয়ে বসতে পারে, এটি তার ভাবনায় এলো এবং অনেকটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন তিনি। জেনারেল টার্ন করলেন পশ্চিমের বিজয়ী পপুলিস্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর দিকে। উদ্দেশ্য ছিল মুজিবের বিরুদ্ধে তাকে লেলিয়ে দিয়ে দূর থেকে খেলা দেখা আর চুপি চুপি হাততালি দেওয়া। ভুট্টো ছিলেন চতুর। তিনি এ সুযোগ লুফে নিলেন জিন্নাহ-পলিসি প্রয়োগ করে। বললেন, মুজিব যদি চান, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পারেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে। কিন্তু পাঞ্জাব ও সিন্ধু হচ্ছে 'পাকিস্তানের ক্ষমতার দুর্গ'। ভুট্টো নিজেকে ভাবতে শুরু করলেন পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি। দুই নেতার মধ্যে ক্ষমতা-বণ্টন চুক্তি করতে চাইলেন তিনি। মুজিব ও তার ক্রুদ্ধ তরুণ সমর্থকেরা নাকচ করলেন তা।

দুই মাসেরও বেশি সময় কেটে গেল। পাকিস্তানের জনগণ সংগ্রাম করতে থাকলেন মনের সঙ্গে আর সংখ্যা নিরূপণ করে চললেন কবে পাবেন তারা গণতন্ত্রের স্পর্শ। পরিস্থিতি জগাখিচুড়ি হয়ে উঠল। বাড়তে থাকল ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যকার রাজনৈতিক দূরত্ব। শুরুতে পাকিস্তানের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে খুব অল্প হলেও সমর্থন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে কোনো কিছুর পরোয়া না করে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি আহ্বানে সময় ক্ষেপণ করছিলেন ইয়াহিয়া। ২৫ মার্চ এটি আহ্বান করার কথা জানালেন তিনি। এর মধ্যে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ভান করলেন মুজিবের সঙ্গে সমঝোতার। ওয়াশিংটনের আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞরা নিঙ্ন ও কিসিঞ্জারকে সতর্ক করলেন এই বলে যে ইয়াহিয়া যদি নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ না করে বল প্রয়োগ করেন, পূর্ব পাকিস্তানে সহিংস হয়ে উঠতে পারে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। ঢাকার দূতাবাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ঝড়ের গতিতে জানানো হলো, ২৫ মার্চ ডেডলাইন সামনে রেখে নামানো হতে পারে সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান পূর্ণ করে ঢাকায় সৈন্য নামানো শুরু হয়ে গেছে। আর্চার ব্লাড ও তার কর্মকর্তারা আশঙ্কা করলেন, সেনাবাহিনী যে বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, এর পরিণতি স্বাভাবিক নয়। এর সমাপ্তি হবে 'রক্তস্নান'-এর মধ্য দিয়ে। তারা তাদের সরকারকে অনুরোধ করলেন, পূর্বে আক্রমণ হলে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করা হবে এমন হুমকি যেন দেওয়া হয় পাকিস্তানকে। যদিও বিষয়টি মার্কিন পলিসির সঙ্গে খাপ খায় না, তবু কিসিঞ্জার হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিলেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বলা ঠিক হবে না যে পাকিস্তান কীভাবে চলবে, না চলবে। তিনি প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, 'সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে এ মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় থাকা এবং কিছু না করা, যে পর্যন্ত না ইয়াহিয়া আপত্তিকর কিছু করেন।' নিঙ্ন বিশ্বাস করতেন যে ইয়াহিয়া হবেন একজন 'দায়িত্বশীল নেতা' এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঠেকাতে অত্যন্ত কুশলী। ইয়াহিয়াকে সেনা ব্যবহার বিষয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সতর্ক করার অনুরোধ নাকচ করে দিল হোয়াইট হাউস।

ইয়াহিয়া, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিলেন লে. জে. টিক্কা খানকে, যিনি নিষ্ঠুর সেনাপতি ছিলেন, যাকে বলা হতো 'বালুচিস্তানের কসাই'। মার্চ শেষ হতে চলল। ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকায় নামলেন অস্ত্রে সজ্জিত নিরাপত্তা-বেষ্টনীতে। আপাতদৃষ্টে যদিও বোঝা গিয়েছিল তারা এসেছেন মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইয়াহিয়া এখানে এসেছিলেন টিক্কা খানের সঙ্গে এক সামরিক পরিকল্পনা শেয়ার করতে যে দেশের জনগণের ওপর কীভাবে তা প্রয়োগ করা যায়। ২৫ মার্চ ঢাকার রাস্তায় নেমে এলো আন্দোলনকারীরা। ওই দিন ইয়াহিয়া করাচি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন ওই রাতেই 'অপারেশন সার্চলাইট' শুরু করার।

ইয়াহিয়া ও টিক্কা খান স্পষ্টভাবে স্থির করলেন তাদের লক্ষ্য। গ্রেফতার করা হলো মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের। অপারেশনে নেতৃত্ব দিতে রাস্তায় নেমে এলো যুক্তরাষ্ট্র-নির্মিত এম-২৪ ট্যাংক। অস্ত্রবর্ম সারি বেঁধে রাখা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। পুরান ঢাকাকে, যেখানে বহু হিন্দু বাস করে, ঘিরে রাখা হলো চারদিক থেকে। অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী এবং বহু শিক্ষার্থীর ওপর চালানো হলো বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ। নিধন করা হলো হাজারের মতো মধ্যম ও গরিব শ্রেণীর হিন্দুকে। শহরের ওপর অগি্নগোলা ও কামান দাগা হলো। রাতভর এবং পরদিন শোনা গেল গোলাগুলির শব্দ। ইয়াহিয়া জাতীয় বেতারে এসে ঘোষণা করলেন সামরিক আইন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল ঢাকার বাইরের সঙ্গে। সংবাদপত্র অফিসে আক্রমণ হলো। বিদেশি সাংবাদিকদের পর্যন্ত করা হলো আটক। কাউকে কাউকে বহিষ্কার করা হলো। অর্থাৎ সংবাদ সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো তাদের ওপর। ভয়েস অব আমেরিকা তাদের নিউজ বুলেটিনে সাধারণভাবে জানাতে থাকল পাকিস্তান সরকারের প্রেস ব্রিফিং। কিন্তু হত্যার প্রকৃত সংবাদ বেরিয়ে আসছিল অন্য মাধ্যমে।

 

 

সর্বশেষ খবর