সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

বিদ্যুৎ উৎপাদনে নজিরবিহীন রেকর্ড

বিদ্যুৎ উৎপাদনে নজিরবিহীন রেকর্ড

নবম সংসদ নির্বাচনে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ সরকার। আর এ অঙ্গীকার ছিল নির্বাচনী ইশতেহারে। আর পাঁচ বছরের শাসন শেষ হওয়ার আগে সেই অঙ্গীকারের চেয়ে আরও প্রায় ৫০ শতাংশ বেশিই বিদ্যুৎ উৎপাদন করার দাবি করে আলোক উৎসবও পালন করেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে দৈনিক বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ৬ হাজার মেগাওয়াট। বছর চারেক আগে এই উৎপাদন ছিল এর অর্ধেক। 
উৎপাদন বাড়লেও কিন্তু এ নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের অন্ত নেই। তাদের প্রধান অভিযোগ, বিদ্যুতের দাম কমেনি বরং দফায় দফায় বেড়েছে। কারণ তেলভিত্তিক কেন্দ্রের ওপর নির্ভরতার কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য না কমে বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে মেয়াদকালে অসংখ্যবার দাম বাড়িয়েও এ খাতকে ভর্তুকিমুক্ত করা যায়নি। বরং ভাড়া ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। এদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় বড় চুক্তি স্বাক্ষর ও পরিকল্পনা তৈরি করলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলোর নির্মাণ স্বল্প মেয়াদে সম্ভব নয়, বলা যেতে পারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কেবল 'স্বপ্ন'ই রয়ে গেল। 
দেশের মোট ৬২ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে বলে দাবি সরকারের। সরকার ক্ষমতায় এসেই প্রথম হাত দেয় বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে। এ জন্য প্রথম বছর গেছে শুধু পরিকল্পনা করতে। এর পর চুক্তি সই ও উৎপাদন বৃদ্ধির দীর্ঘ প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। সরকারের এ মেয়াদ পূরণের আগে এগুলোর নির্মাণ এখন তাই কেবল 'স্বপ্ন'।
ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি হলেও সঞ্চালন অপচয়ের কারণে বাংলাদেশ পাচ্ছে ৪৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অথচ এই ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ হিসাবে রেখেই সরকার গত নভেম্বরে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের দাবি করে আলোক উৎসব করে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার যেসব কেন্দ্র থেকে বা আমদানিকৃত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়নি সেসবকেও হিসাবের আওতায় এনে এ উৎসব করেছে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এ আওয়ামী লীগ সরকার মোট ৫৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে। যার অনেকগুলোর এখনো উৎপাদন শুরু হয়নি। অনেকগুলো বন্ধ পড়ে আছে।
তবে আশার কথা হলো বিদায়ী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো ৩ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৬৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। যা দেশে সর্বোচ্চ। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপিত ক্ষমতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি দুটিতেই সরকার রেকর্ড করেছে। এ ছাড়া ভারত থেকে চুক্তির পুরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ না পেলেও এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার দীর্ঘকালেরও কথিত বিষয়টিরও বাস্তবায়ন হয়েছে। আশঙ্কার বিষয় এই যে, সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাভুক্ত ও বাস্তবায়নাধীন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও পূর্ণ ক্ষমতায় চালু হয়নি। বিদ্যুৎ খাতকে অতিমাত্রায় নির্ভর করতে হচ্ছে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ওপর। ইতোমধ্যেই এ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরকারের চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। আর বড় কেন্দ্রগুলো চালু না হওয়ায় সরকারকে বাধ্য হয়ে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তিতে যেতে হচ্ছে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্টরা এ কথা স্বীকার করেছেন, বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে এখনো ঘাটতি আছে। সমস্যা আছে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থাতেও। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংস্থান ও সরবরাহ, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পরিকল্পিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি ইস্যুর সমাধান করাই সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানান, বড় কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে না আসায় এবং ছোট কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরতা না কমায় বিদ্যুতের গড় উৎপাদন মূল্য কমার কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বুয়েটের অধ্যাপক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক সহকারী ড. তামিম জানান, সরকার বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা টেকসই নয়। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার সমস্যা রয়েই গেছে। 
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, শেষ সময়ে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। যেমন- কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি কীভাবে আসবে তা নির্ধারিত হয়নি। এ ছাড়া এই খাতে বিনিয়োগের বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। অতীতে এ ধরনের বহু চুক্তি হলেও বিনিয়োগের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। রাশিয়ার অনুদানের টাকা দিয়ে লোক দেখানো বিদেশ ভ্রমণ, ভিত্তিপ্রস্তর ইত্যাদি করা হচ্ছে। সহসা পারমাণবিক ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর নির্মাণ কেবল স্বপ্ন। এ অধ্যাপকের মতে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে শুধুমাত্র কিছু লোকের ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিল হবে। এ বিষয়ে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকারের গৃহীত বড় প্রকল্পগুলো 'অস্বচ্ছ'। আর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা বলে সরকার যে মোটা অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে তা কোথায় এবং কীভাবে ব্যয় হচ্ছে তাও জনগণের কাছে অস্বচ্ছ।

সর্বশেষ খবর