বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা
পেট্রলবোমায় দগ্ধ দুজনের মৃত্যু

\\\'আমার বাবারে ফিরায়ে দ্যাও আমরা আর ঢাকা থাকুম না\\\'

\\\'আমার বাবারে ফিরায়ে দ্যাও আমরা আর ঢাকা থাকুম না\\\'

বাবা বাবা, ও বাবা। মা, আমি বাবার কাছে যামু। তোমরা আমার বাবারে ফিরায়ে দ্যাও। আমরা আর ঢাকা থাকুম না, গ্রামে চইল্লা যাইমু। বাবা হারানো ছোট লিটনের কান্নায় গতকাল ভারি হয়ে উঠেছিল বার্ন ইউনিটের পরিবেশ। লিটনের এমন কান্নায় সেখানো দাঁড়ানো চিকিৎসক, সাংবাদিক, সেবিকা এবং রোগীর স্বজনরা কেউ ধরে রাখতে পারেনি চোখের পানি। আর স্বজনদের বিলাপে ভারী হয়ে উঠেছিল বার্ন ইউনিটের পরিবেশ। বার্ন ইউনিটের নিচতলায় সিঁড়ির পাশে ফরিদের (৬০) স্ত্রী হালিমা আক্তার বিলাপ করে বলছিলেন, 'আমাগো কী দোষ আছিলো। ছোট ছোট পোলাপাইন লইয়্যা আমি কই যামু? আমারে কি হাসিনা-খালেদা খাওন দিব? আমি এহন কী করমু।' হালিমা আক্তার জানায়, গত শুক্রবার রাস্তায় কোনো সমস্যা হবে না- এমনটা ভেবে ফজরের নামাজের পর ব্যবসার মালামাল আনতে ক্যান্টনমেন্টের বালুরঘাট এলাকার বাসা থেকে গুলিস্তান যাচ্ছিলেন ফরিদ মিয়া। নরসিংদীর বেলাবো এলাকায় তাদের গ্রামের বাড়ি। ২০ বছর ধরে বালুরঘাটে বাসবাস করছেন তারা। তাদের এক মেয়ে ও তিন ছেলে। বড় মেয়ে সালমার বিয়ে হয়েছে। তিন ছেলে স্বপন মিয়া, সুজন মিয়া ও লিটন মিয়া। স্বামীর আয়েই সংসার চলে তাদের। স্ত্রীকে হারিয়ে কপাল চাপড়ে কাঁদছেন ফকরুজ্জামান। তখন শাহীনার মৃতদেহের গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরানো হচ্ছিলো মর্গের ভেতরে। বার্ন ইউনিট থেকে অপরিষ্কার মরিচাধরা যে ট্রলিটি দিয়ে তাকে আনা হয়েছিল ড্রেনের ওপর কাত করে রেখে সেটিও ধোয়া হচ্ছে। মর্গের সামনের রাস্তায় কাঠের তৈরি একটি কফিন রাখা আছে। শাহীনার স্বজন এবং সহকর্মীদের অশ্রুসিক্ত কান্না। তারা অপেক্ষা করছেন মৃতদেহটি বুঝে নিতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে শাহিনার ছোট বোন বিপাশা আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তাদের বাড়ি খুলনার টুটপাড়ায়। অফিসের কাজে খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। কাজ শেষ করে ঘটনার দিনই খুলনার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি ফেরা হলো না তার। একমাত্র সন্তানকে রেখে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। বিপাশা আরও জানায়, শাহীনার একমাত্র ছেলে আতিকুজ্জামান মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। সে বর্তমানে আটলান্টিক মহাসাগরে জাহাজে আছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরবেন। এর পরই খুলনায় গ্রামের বাড়িতে শাহিনা আক্তারের লাশ দাফন করা হবে। ছেলের অপেক্ষায় শাহীনার লাশ রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) পরিচালক শাহ আলম ভূঁইয়া জানান, শাহিনা চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার দিকে মারা গেছেন। আর মাত্র আট ঘণ্টার ব্যবধানে গতকাল সকাল ১০টার দিকে ফল বিক্রেতা ফরিদ মারা যান। ফল বিক্রেতা ফরিদ মিয়াও বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। জানা গেছে, ৩ জানুয়ারি সকাল সাতটার দিকে পরিবাগে আবদুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তানগামী একটি যাত্রীবাহী মিনিবাসে পেট্রলবোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এতে শাহিনা ছাড়াও বাসের চালক বাবুল হাওলাদার ও অপর যাত্রী ফল বিক্রেতা ফরিদ মিয়া মারাত্দক দগ্ধ হন। এর পর তাদের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। শাহিনার শরীরের ৪০ ভাগ দগ্ধ হয়েছিল। চিকিৎসকেরা শুরুতেই জানিয়েছিলেন, তাদের অবস্থা গুরুতর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থশংকর পাল জানান, শাহিনার শরীরের নিচের অংশের ৬৪ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। শারীরিক যন্ত্রণার মাত্রা গত মঙ্গলবার বেড়ে যায়। আর ফরিদ মিয়ার শ্বাসনালিসহ শরীরের ৪৮ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। যার কারণে তাদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এদিকে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাসেবা অপর্যাপ্ত বলে অভিযোগ করেছেন অগি্নদগ্ধদের স্বজনরা। চিকিৎসক এবং সেবিকারা রোগীর স্বজন এবং রোগীদের সঙ্গে অশালীন ও অমার্জিত ব্যবহার করেন বলে এই প্রতিবেদককে তারা অভিযোগ করেন। তবে সরেজমিন দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া রোগীদের ক্ষত পরিষ্কার করা, অসহ্য যন্ত্রণার কারণে ক্ষত পরিষ্কার করতে অসম্মতির কারণে চিকিৎসকরা অনেক সময় স্বজনদের বকা দেন। অভিযোগের সত্যতা জানতে চাইলে দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, রোগীদের ভালোর জন্য মাঝে মধ্যে একটু বকা দিতে হয়। এতে রোগীদেরই লাভ হয়। চিকিৎসক আরও জানান, নিয়মিত ড্রেসিং এবং পরিষ্কার না করলে ইনফেকশন হয়। তখন রোগীদের যন্ত্রণা আরও বাড়ে।

 

 

সর্বশেষ খবর