বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
আজ শুরু হচ্ছে গণভোট

স্কটল্যান্ড কি আলাদা রাষ্ট্র হচ্ছে

আজই অনেকটা সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে ৩০৭ বছরের সংসারে গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে স্কটল্যান্ড থাকবে কি না। স্কটল্যান্ডের মানুষ স্বাধীন হবে, নাকি অন্যের সঙ্গে থাকবে? এটি আজই জানা যাবে। কারণ আজ এ সিদ্ধান্তে শুরু হয়ে গেছে গণভোট। তবে এ স্বাধীনতার বিপক্ষেও তোড়জোড় কম নয়। বিশেষ করে ব্রিটিশ সরকার কোনোভাবেই চাচ্ছে না স্কটল্যান্ড আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হোক। কোনোভাবেই আর ছোট না হোক গ্রেট ব্রিটেনের মানচিত্র। তবে স্কটল্যান্ডের জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিলে ব্রিটেনের মানচিত্রই শুধু ছোট হবে না, বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে ব্রিটেনের অবস্থানের আমূল পরিবর্তন অনিবার্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে এটিও ভাবা হচ্ছে যে, ব্রিটেন আজ গোটা বিশ্বে যেভাবে পরিচিত স্কটল্যান্ড কি পারবে সেভাবে নিজেকে পরিচিত করাতে? এ ছাড়া স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য থাকবে কি না, তা-ও বড় প্রশ্ন। কেননা ইইউর সদস্যপদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপ ও এর বাইরে বিভিন্ন বাজারের সঙ্গে ইইউ সদস্যদের পক্ষে দেনদরবার করে বাণিজ্য চুক্তি করে। আর স্বাধীনতা প্রত্যাখ্যান করলে স্কটল্যান্ডের হাতে আরও ক্ষমতা দেওয়ার সব অঙ্গীকার করেছে ব্রিটেনের প্রধান তিনটি দল। দেশটির মূল তিনটি দলের নেতা অর্থাৎ কনজারভেটিভ দলের প্রধান ডেভিড ক্যামেরন, লেবার দলের এড মিলিব্যান্ড এবং লিব ডেম দলের নিক ক্লেগ তিনজনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, স্কটিশরা স্বাধীনতা প্রত্যাখ্যান করলে তারা স্কটল্যান্ডের কাছে আরও ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। গণভোটের আগে শেষবারের মতো গত পরশু সেখানে সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। আবেগাপ্লুত এক ভাষণে ক্যামেরন স্কটিশদের ব্রিটেন ছেড়ে না যাওয়ার আবেদন জানান। ভাষণে তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত কেবল এ প্রজন্মের স্কটিশদের জন্য নয়, বরং এটি তাদের সন্তান, নাতি-নাতনি এবং তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও। তিনি সতর্ক করে বলেন, ভাঙন হলে তা হবে বেদনাদায়ক বিচ্ছেদের মতোই।
এক নজরে স্কটল্যান্ড : গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের উত্তর তৃতীয়াংশে অবস্থিত স্কটল্যান্ড। রাজধানী এডিনবার্গ, যা দেশটির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আর গ্লাসগো স্কটল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ১৬০৩ সালে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের রাজবংশ রাজা প্রথম জ্যাকবের অধীনে একত্রিত হয়। ১৭০৭ সালে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের আইনসভা একত্রিত হয়। আজ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড নিজস্ব বিচারব্যবস্থা, নিজস্ব গির্জা, নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা, এমনকি নিজস্ব মুদ্রা ধরে রেখেছে। ১৯৯৯ সাল থেকে স্কটল্যান্ডের নিজস্ব আইনসভা রয়েছে এবং তখন থেকেই দেশটি স্বায়ত্তশাসিত। স্কটল্যান্ডের উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগর, পূর্বে উত্তর সাগর, দক্ষিণ-পূর্বে ইংল্যান্ড, দক্ষিণে সলওয়ে ফার্থ ও আইরিশ সাগর এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর ও নর্থ চ্যানেল; যা আয়ারল্যান্ড ও গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত। ভূ-রাজনৈতিক একতার ভিত্তিতে প্রায় ১৮৬টি দ্বীপ স্কটল্যান্ডের শাসনাধীন। দ্বীপগুলোকে গণনায় ধরে স্কটল্যান্ডের মোট আয়তন ৭৮ হাজার ৮০ বর্গকিলোমিটার।
কী চায় স্কটিশরা (প্রবাসীসহ) : স্কটল্যান্ডের খোদ নাগরিকদের মধ্যেও স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে নানা দোটানা রয়েছে। তবে স্বাধীনতার পক্ষেই বেশির ভাগ মতামত। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নিয়াজ হায়দার। পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরে ১৫ বছর আগে গ্লাসগোয় স্থায়ী হয়েছেন প্রবাসী এই বাংলাদেশি। স্ত্রী মুনমুন হায়দার, একজন মনোবিজ্ঞানী। মেয়ে নাদিয়া হায়দার গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করছেন। বাবা এবং মেয়ে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে। তবে স্ত্রী এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কেননা সারা বিশ্বে ব্রিটেনের যে খ্যাতি, যে প্রভাব তা তিনি উপভোগ করেন। নিয়াজ হায়দার মনেপ্রাণে চাচ্ছেন স্কটল্যান্ড স্বাধীন হোক। কেননা ব্রিটেনের যুদ্ধবাজ নীতি তার একেবারেই পছন্দ নয়। তা থেকে তিনি নিজেও মুক্তি চান। অন্যদিকে গ্লাসগোতেই জন্ম নেওয়া ডেভিড ওয়ারেন বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি ব্রিটেনের সঙ্গেই স্কটল্যান্ড ভালো আছে। মন্দা থেকে উত্তরণ হচ্ছে। কেন আবার একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে যেতে হবে, আমি বুঝতে পারছি না।’
স্বাধীন হলে কী হবে : স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা ঠেকাতে তৎপর ছিলেন ব্রিটেনের ক্ষমতাসীনরা। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিলে চিরদিনের জন্য তাদের পরস্পরের পথ আলাদা হয়ে যাবে। শুধু ক্যামেরনই নন, ব্রিটেনের মূলধারার সব দল ও রাজনীতিক স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট আদায়ের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন, ব্রিটিশ নেতাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
এখন দেশটি স্বাধীন হলে ব্রিটেনের জন্য বড় ধাক্কা হবে ৩২ শতাংশের মতো ভূমি হারানো। জনসংখ্যা কমবে প্রায় ৮ শতাংশ। ব্রিটেনের বর্তমান জনসংখ্যা ৬৪ থেকে নেমে ৫৬ মিলিয়নে আসবে। এর ফলে ইউরোপে জনসংখ্যার দিক দিয়ে ব্রিটেনের অবস্থান নিচে নেমে যাবে। বর্তমানে ইতালির জনসংখ্যা ৬০ মিলিয়ন। জার্মানির জনসংখ্যা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮২ মিলিয়ন। অন্যদিকে ব্রিটেনের গড় আয় বৃদ্ধি পাবে। প্রতিজনের হিসাবে আয় দাঁড়াবে ১৬ দশমিক ৭৯১ পাউন্ড। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কিছু লোক ব্রিটেনে গিয়ে বসবাসের সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি স্কটল্যান্ডেও কিছু লোকের বসবাসের সুযোগ তৈরি হবে। এদিকে স্কটল্যান্ডের কথা উঠলে প্রথমেই আসে স্কচ হুইস্কির কথা। যাদের মদ্যপানের অভ্যাস আছে, তারাই বুঝতে পারবেন সেখানকার স্কচ হুইস্কির বিশেষত্ব। স্কটল্যান্ডের পানি, বার্লি, ওক কাঠ এবং শত বছরের অভিজ্ঞতার কল্যাণে স্কচ হুইস্কি অতুলনীয়। এটি শুধু পানীয়ই নয়, স্কটল্যান্ডের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। দেশটির সম্পদের মধ্যে তেল-গ্যাসের পর যার নাম করা হয়, তা হলো হুইস্কি। বিশ্বের ২০০ দেশে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি পাউন্ডের হুইস্কি রপ্তানি হয়, যা স্কটল্যান্ডের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশ। ব্রিটেনে ২০১৫ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নের ইতিবাচক মীমাংসা হলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচন পেছানো যাবে না। সে ক্ষেত্রে স্কটল্যান্ড থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য হয়তো ব্রিটেনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো আইন প্রণয়নে অংশ নিতে পারবেন না। এ ছাড়া স্বাধীন স্কটল্যান্ডে আরও যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে সেগুলো হলো
সংবিধান : সংবিধান রচনার আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী নেতারা। ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ ও ট্রেড ইউনিয়নকে নিয়ে এ সংবিধান প্রণয়ন করতে চান তারা। প্রসঙ্গত, ব্রিটেনের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। স্কটিশ সংবিধানে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।
রাজতন্ত্র : স্কটিশ জাতীয়তাবাদী পার্টি (এসএনপি) জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার মতো ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সার্বভৌমত্ব মেনে নেবে তারা এবং কমনওয়েলথে যোগ দেবে। জরিপে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, অন্তত ১৭ শতাংশ ভোটার এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তারা জানেন না কোন পক্ষে ভোট দেবেন। উভয় পক্ষই এসব ভোটারের মন জয় করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, এরাই হবে গণভোটের ফলাফল নির্ধারক। স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট দিতে স্কটিশদের নানাভাবে উৎসাহিত করেছে ব্রিটিশ সরকার। এ বিষয়ে বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদেরও ব্যবহার করা হয়েছে। ফুটবল তারকা ডেভিড ব্যাকহামও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন নিজ দলের অবস্থানের কথা স্বীকার করে স্কটিশদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা যদি আমাকে পছন্দ না করেন আমি আর কখনো স্কটল্যান্ডে আসব না। আপনারা না চাইলে বর্তমান সরকার আর ক্ষমতায় আসবে না। কিন্তু আপনারা যদি যুক্তরাজ্য থেকে আলাদা হয়ে যান, তবে এ সম্পর্ক আজীবনের জন্য ভেঙে যাবে।’ ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ড ও ব্রিটেনের অভিন্ন যাত্রায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক। ফলে স্বাধীনতার পর খুব দ্রুত পরিবর্তন আসবে এমন প্রত্যাশা কারোর মধ্যেই নেই। তবে আজকের গণভোটই চূড়ান্ত রায় দেবে স্কটল্যান্ড আলাদা রাষ্ট্র হচ্ছে কি না। বিবিসি, এএফপি, আলজাজিরা।

সর্বশেষ খবর