বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

শৃঙ্খলিত শহর কাঠমান্ডু

কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে হোটেল পার্ক ভিলেজ- প্রায় ১০ কিলোমিটার পথে কোথাও রিকশা-ভ্যান চোখে পড়েনি। খটকা লাগে, তাহলে কি রিকশা-ভ্যান নেই রাজধানী শহর কাঠমান্ডুতে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পুরো শহরে রিকশা আছে শখানেক। তাও পর্যটকদের সুবিধার্থে শুধু থামেল মার্কেট এলাকায় চলাচল করে। এর বাইরে গোটা রাজধানী শহরের স্থানীয়রা প্রায় সবাই গণপরিবহন বাস, মাইক্রোবাস, নিজস্ব মোটরবাইক অথবা হেঁটে যাতায়াত করেন।
পর্যটন ও কৃষি নির্ভর অর্থনীতির কাঠমান্ডুর অধিবাসীদের একটি বড় অংশ ব্যবসায়ী। শহরের ছোট-বড় সড়কের দুই পাশে অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেখানে পর্যটক ও স্থানীয়দের প্রয়োজনীয় পণ্য পরিপাটি করে থরে থরে সাজানো। দোকানি কখনো নারী, আবার কখনো পুরুষ। এমনটি হওয়ার কারণ, এখানকার অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই পরিবারের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে পরিচালনা করেন। সংসার সামলে স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গে দোকানদারি করেন। আবার স্বামী চাকরিজীবী হলে স্ত্রী সংসারসহ সামলান ব্যবসাও। কাঠমান্ডুর লাজিমপাত সড়কের পাশে ছোট্ট স্টেশনারি দোকান চালান রাজেশ্বরী। তার স্বামী রাজেশ সরকারি চাকুরে। একমাত্র ছেলে অমেশ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বললেন, দোকানদারিও সংসারের একটা অংশ। কাঠমান্ডু শহরের সেন্টার টাউন এলাকার চায়তং শপিং কমপ্লেক্সের খেলনা ব্যবসায়ী দীপেশ মিত্তাল জানালেন, কাঠমান্ডুর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই ছোট-বড় ব্যবসায়ী। পর্যটকদের ঘিরেই এখানে ব্যবসা বেশ জমজমাট। রাজধানীর সড়কগুলোয় ময়লা-আবর্জনার কোনো স্তূপ চোখে পড়েনি। মনে হয়েছে এখানকার সবাই পরিচ্ছন্নতাকে বেশি প্রাধান্য দেন। স্থানীয় মহানগর পালিকার (সিটি করপোরেশন) পরিচ্ছন্নতা বিভাগ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি অধিবাসীরাও সড়কগুলো ঝাঁট দিয়ে চকচকা করে রাখেন। পয়ঃনিষ্কাশনের ড্রেনেজ-ব্যবস্থাও চোখে পড়ার মতো। শহরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে ছোট-বড় পাঁচ-ছয়টি খাল চোখে পড়ে। এসব খালের পানি তলানি পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু সেখানে নেই পলি বা বর্জ্যরে স্তূপ। চওড়া কয়েকটি খালের পাড় দিয়ে ওয়াকওয়ে থাকলেও নেই অবৈধ কোনো দখলদারির চিহ্ন। ফুটপাথগুলোও পরিচ্ছন্ন। সেখানে হকারদের কোনো দখলদারি নেই। শহরের অধিবাসীদের ফুটপাথ ধরে চলাটাই যেন জন্মগত অভ্যাস। সড়ক ডিভাইডারগুলোর মধ্যে নেই তারকাঁটার বেড়া। এর পরও সড়কের যেখান থেকে খুশি দৌড়ে রাস্তা পারাপারের দৃশ্য চোখে পড়েনি। এখানকার মানুষের জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করে দল বেঁধে রাস্তা পারাপারের দৃশ্য চোখে লাগার মতো। ট্যাক্সিক্যাব চালক রাজু লামা বলেন, শহরের সড়কগুলোয় কোথাও ডাস্টবিন পাবেন না। সন্ধ্যার পর নগরবাসী নিজ নিজ বাড়ির সামনে নিত্যদিনের বর্জ্য জড় করেন এবং মহানগর পালিকার পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মচারীরা এসে নিয়ে যান। রাতভর চলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কর্মযজ্ঞ। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিষয়টিও কাঠমান্ডুর অধিবাসীদের কাছে শেখার মতো। আইন মানেই তাদের কাছে মান্যবর, বড় কিছু। আইন প্রয়োগে পুলিশি ব্যবস্থা পুরনো। পুলিশ স্টেশনগুলো ও তাদের ব্যবহৃত যানবাহন সেকেলে। তার পরও আইন প্রয়োগের দিক দিয়ে তারা অনেক এগিয়ে। তাই সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশ মানেই ভীতি। সার্ক সম্মেলনকে ঘিরে পুলিশি ঘোষণা ছিল- সপ্তাহ ধরে এক দিন জোড় পরদিন বিজোড় সংখ্যার গাড়ি শহরে চলবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ট্যাক্সিক্যাব চালক অশোক শর্মা বলেন, পুলিশের নির্দেশ অমান্য করার সাহস কোনো চালকই দেখান না। এ প্রসঙ্গে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে কর্তব্যরত স্থানীয় পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) এইচ আর রয় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জনগণের মঙ্গলেই পুলিশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে। সাধারণ মানুষও ভক্তিভরে আইনকে মান্য করে। রাত ৯টার মধ্যেই শহরের প্রায় সব দোকান বন্ধ করার নির্দেশ রয়েছে স্থানীয় পুলিশের। এই নির্দেশের বাইরে কেউ যায় না। প্রকাশ্যে খোলা বাজারে মদ বিক্রি হয়। কিন্তু সড়কে রাতে মাতলামির কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি। বিদ্যুৎ ব্যবহারেও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন নেপালের শহরগুলোর কর্মকর্তারা। অনেক সড়কে সৌরশক্তির ব্যবহারে রাতে বাতি জ্বালানো হয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে সড়কবাতির পোলগুলোয় ব্যাটারি আর সৌর প্যানেল বোর্ড স্থায়ীভাবে লটকানো রয়েছে, বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলেও যেন সড়কগুলো ভুতুড়ে রূপ না নেয়। এরকম অনুকরণীয় ব্যবস্থা হতে পারে আমার বাংলাদেশেও।

সর্বশেষ খবর