শিরোনাম
শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা
শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন

২০০ প্রাচীন পাণ্ডুলিপির এক লাইব্রেরি

২০০ প্রাচীন পাণ্ডুলিপির এক লাইব্রেরি

তালপাতায় সংস্কৃত ভাষায় শ্রীরাম দত্তের লেখা পুঁথি। কিংবা তুলট কাগজে হাতে লেখা মহাভারত। প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা গ্রন্থ রাবণ ইন্দ্রজিৎ সংবাদ, আর তুলট কাগজে হাতে লেখা মোটা মোটা বই। যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরিতে সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় লেখা এরকম প্রাচীন পাণ্ডুলিপিই আছে দুই শতাধিক। আছে আট ফুট লম্বা কাগজে ১৮৪২ সালে বাংলা ভাষায় দেওয়া আদালতের রায়। এসব প্রাচীন পুঁথি, পাণ্ডুলিপি ও দলিলপত্রের লেখার বিষয়বস্তু আজও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। হয়নি এসব নিয়ে তেমন গবেষণা। মূল্যবান এসব সংগ্রহশালার পাশাপাশি লাইব্রেরিতে রয়েছে ৮০ হাজার বইয়ের বিশাল সংগ্রহ, যার মধ্যে বাংলা ভাষার ৫৭ হাজার ৮০৮টি, ইংরেজি ভাষার ১৮ হাজার ৪২৪টি এবং অন্যান্য ভাষার ৩০০ বই রয়েছে। এসব বইয়ের মধ্যে ৬০ ভাগই উপন্যাস। ৩০ ভাগ রেফারেন্স ও ১০ ভাগ গবেষণামূলক। প্রাচীনতার দিক থেকে এ লাইব্রেরি অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ১৮০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটের সলিসবারিতে পৃথিবীর প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পাবলিক লাইব্রেরি অ্যাক্ট পাস করে ১৮৫০ সালে। এর পরের বছরই ১৮৫১ সালে রাজনারায়ণ বসু মেদিনীপুরে উপমহাদেশের প্রথম গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আমিরুল আলম খান বলেন, একই বছর যশোরে প্রতিষ্ঠিত হয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় গণপাঠাগার। বিষ্ণুশর্মা পণ্ডিতের লেখা নিবন্ধ অনুযায়ী ১৮৫১ সালে এ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের অন্য তিনটি প্রাচীন পাবলিক লাইব্রেরি রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি, বগুড়া উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি ও বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি। এ তিনটিই ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাসে যশোর পাবলিক লাইব্রেরি বাংলাদেশের প্রাচীনতম, যার বয়স এখন ১৬৪ বছর। অধ্যাপক আমিরুল খান বলেন, যশোর পাবলিক লাইব্রেরিটিই যে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন, সে ব্যাপারে আমাদের কাছে ডকুমেন্ট আছে। প্রায় তিন একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত পাবলিক লাইব্রেরিটি প্রধানত নিজস্ব আয়ে পরিচালিত হয়।
১৯৯৬ সালে এ লাইব্রেরি ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক লাইব্রেরি নেটওয়ার্কের সদস্য হয়। এখানে উন্মুক্ত পাঠকক্ষের পাশাপাশি রয়েছে পত্রিকাপাঠের সুব্যবস্থা, রেফারেন্স বিভাগ ও গ্রন্থপাঠের সুযোগ। অধ্যাপক আমিরুল আলম খান বলেন, ৬০ ও ৭০-এর দশকে লাইব্রেরিটি সত্যিকার অর্থে পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে গড়ে ওঠে। অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফ হোসেনের নেতৃত্বে একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনীর কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল। তার কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশে গণগ্রন্থাগার আন্দোলনের প্রথম রাষ্ট্রীয় পুরস্কার (২০০১) তিনি লাভ করেন।
 ১৯৬৭ সালে যশোর পাবলিক লাইব্রেরির উদ্যোগে বইমেলার আয়োজন করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফ হোসেন। সেটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। বিশিষ্ট গবেষক বেনজিন খান বলেন, নিউটনের ‘দ্য প্রিনসিপিয়া’, ডারউইনের ‘দ্য অরিজিন অব স্পিসিস বাই মিনস অব নেচারাল সিলেকশনস’-এর প্রথম সংস্করণ ছিল লাইব্রেরিতে। বিজ্ঞানীদের লেখা প্রায় সব বইয়ের প্রথম সংস্করণ ছিল। সব চুরি হয়ে গেছে। আকর্ষণীয় দিক ছিল সেমিনার আয়োজন। এখন তা বন্ধ। ‘স্বরবর্ণ’ নামে একটি পত্রিকা বের হতো। এখন কর্মকর্তাদের তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সদস্যপদ দেওয়া হচ্ছে না। অধ্যাপক আমিরুল আলম খান বলেন, ১৯২৮ সালে যশোর পাবলিক লাইব্রেরি, নিউ আর্য থিয়েটার ও টাউন ক্লাবকে এক করে যশোর ইনস্টিটিউট করা হয়। লাইব্রেরি কেমন চলবে তা নির্ভর করে যশোর ইনস্টিটিউটের পরিচালকমণ্ডলীর ওপর। এ পদে দায়িত্ব পালনকারীরা যদি লাইব্রেরিবিদ্বেষী হন, তাহলে বাণিজ্যের দিকে মনোযোগ বেশি যাবেই। একসময় যশোর পাবলিক লাইব্রেরি পাঠক তৈরি করেছে। এখন বন্ধ। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সাজানো-গোছানো হাজার হাজার বই, টেবিল, চেয়ার। বিশাল পড়ার রুমে পাঠক মাত্র দুজন। গবেষকদের জন্য আলাদা বিশাল ঘর। একজনও নেই সেখানে। ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক শেখ রবিউল আলম বলেন, ‘ব্যবসা নয়, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যে অনুষ্ঠান করে তার জন্য টাকা নেওয়া হয় না। বাণিজ্য মেলার আয় লাইব্রেরি পায়। সদস্যসংখ্যা ৩ হাজার ২০০। সে কারণে ঢালাওভাবে সদস্যপদ দেওয়া হচ্ছে না। পাঠক আনার জন্য চেষ্টা করছি।’

সর্বশেষ খবর