মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
যাত্রীদের সঙ্গে চলে তুই-তোকারি

শাহজালালে যত যাত্রী হয়রানি

শাহজালালে যত যাত্রী হয়রানি

হাজারো অভিযোগ, একের পর এক বৈঠক, মন্ত্রী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ গোয়েন্দা বিভাগগুলোর নানা তৎপরতায়ও হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধ হচ্ছে না। হয়রানিমুক্ত করার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত তাদের অনেকেই উল্টো যাত্রী হয়রানিতে মেতে উঠেছেন। শুধু বিমানবন্দরের ভিতরে নয়, প্রবেশপথের মোড় থেকেই শুরু হয় হয়রানি। কনকর্স হল, মূল ভবন, ইমিগ্রেশন পুলিশ, কাস্টমস পোস্টসহ ঘাটে ঘাটে চলে ভোগান্তি। তুই-তোকারি থেকে শুরু করে চরম অসৌজন্যমূলক আচরণের পাশাপাশি হুমকি-ধমকিতে যাত্রীদের আতঙ্কিত করে তোলারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে যাত্রীদের টাকা-পয়সা, মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ।
জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও নাজেহালের শিকার হচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশিরা। তারা দেশে ফেরা ও কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ- উভয় ক্ষেত্রেই হয়রানির শিকার হন। ইমিগ্রেশন বিভাগে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা এই প্রবাসী কর্মজীবীদের সঙ্গে সীমাহীন দুর্ব্যবহার করেন। তুই-তোকারি ভাষা, পেটে কলমের গুঁতো দেওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অপমানজনক এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ অনেক যাত্রী দুঃখে-ক্ষোভে কেঁদে ফেলেন। যাদের কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, সেই প্রবাসী কর্মজীবীদের সঙ্গে কাস্টমস বিভাগের আচরণ আরও রূঢ়, আরও ন্যক্কারজনক। বিমানবন্দরে কাস্টমস চেকিং পয়েন্টে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী বাঙালিদের পাসপোর্ট হাতে নিয়েই লাগেজ টেপাটেপি শুরু করা হয়। দায়িত্বরত একশ্রেণির কর্মকর্তার প্রথম প্রশ্ন থাকে, ‘কয় বছর পর দেশে আসলি, আমাদের জন্য কী আনছোস, দে তাড়াতাড়ি।’ যাত্রীরা মানসম্মানের দিকে তাকিয়ে বিদেশি মুদ্রা হাতে গুঁজে দিয়েই দ্রুত বেরিয়ে আসার পথ খোঁজেন। গত রবিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই ভুক্তভোগী কয়েকজন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে নানা অভিযোগ করেন। সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে কর্মরত এসব বাংলাদেশি জানান, ইমিগ্রেশন পুলিশের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ নিয়ে যাওয়ায় এক মহিলা এসির অশ্রাব্য গালাগাল শুনতে হয়েছে। বিমানবন্দর এলাকায় গত দুই দিন সরেজমিন অনুসন্ধানকালে যাত্রী হয়রানির নানা চিত্র লক্ষ্য করা যায়। সেখানে যাত্রীদের আকুতি-মিনতি, অভিযোগের কোনো পাত্তা মেলে না। এমনো অভিযোগ আছে, যাত্রী ভোগান্তি দূর করার পরিবর্তে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা উল্টো অভিযোগকারীকেই ফাঁদে ফেলে হয়রানি করেন। বিমানবন্দর থেকে দেড়শ গজ দূরে প্রবেশপথের চেকপোস্টেও হয়রানি ও দুর্ব্যবহারের শিকার হতে হয়। ভুক্তভোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন, আগে ২০০ টাকার টিকিটে বিমানবন্দরের কনকর্স হল পর্যন্ত তারা প্রবেশ করতে পারতেন। কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় ধরে যাত্রী ছাড়া আর কাউকে বিমানবন্দরমুখী রাস্তায় পা ফেলতে দেওয়া হচ্ছে না। গাড়ি তল্লাশিকালে যাত্রী ও স্বজনদের দুই দিক থেকে এমনভাবে অস্ত্র তাক করে রাখা হয়, যা দেখে শুধু শিশুরাই নয়, বয়স্ক লোকজনও রীতিমতো আঁতকে ওঠেন। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চলমান হরতাল-অবরোধে নাশকতার আশঙ্কায় বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি গত ১৩ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে যাত্রী ছাড়া দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।’ তবে যাত্রীদের গাড়ি থামিয়ে অস্ত্র তাক করে রাখার বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। নিরাপত্তার নামে অস্ত্র উঁচিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির নজির পৃথিবীর আর কোনো বিমানবন্দরে নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশের দায়িত্ব বহিরাগমন, পার্কিং লট, ক্যানোপি, কনকর্স হল, আগমনী কনভেয়ার বেল্ট, টারমাক, রানওয়ে, ড্রাইওয়ে ও অ্যাপ্রোন এলাকায় নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকা। কিন্তু তারা ব্যস্ত থাকেন আগমনী আর কার পার্কিং এলাকায় যাত্রীদের মালামাল তল্লাশিতে। বিদেশ থেকে আসা অনেক যাত্রীই বিমানবন্দরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে গাড়িতে ওঠার পরই এই আর্মড পুলিশের তল্লাশির মুখোমুখি হন। নানা প্রশ্নে বিব্রত করা হয় তাদের। টানাহেঁচড়া করে আবার বিমানবন্দরের ভিতরে নেওয়ারও চেষ্টা করা হয়।
হয়রানি অন্তহীন : যাত্রীদের অভিযোগ, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর পুলিশ, কাস্টমস, কেবিন ক্রুসহ বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের একটা বড় অংশই নিয়মিত হয়রানি করছে। অন্তত ১০টি ধাপে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিতে নানা হয়রানি চালানো হয়। বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে ব্যাংকের বুথে মুদ্রা সংগ্রহ করতে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেক সময় ব্যাংক থেকে জানানো হয়, সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রা নেই। শেষ মুহূর্তে ব্যাংকের আশপাশে অবস্থানকারী অবৈধ মুদ্রা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত দামে তা সংগ্রহে বাধ্য হন যাত্রীরা। বিদেশফেরত যাত্রীরা কাস্টমস হলরুম থেকে বের হওয়ার পর ট্যাক্সিচালক, দালাল, ভুয়া সাংবাদিক, ভুয়া গোয়েন্দা ও ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের খপ্পরে পড়েও নাস্তানাবুদ হন। বহিরাগমন লাউঞ্জের প্রবেশমুখে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী টার্গেটকৃত যাত্রীদের পাসপোর্ট, টিকিট ইত্যাদি চেক করার সময় জানায়, তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে। তাই কোনোক্রমেই তিনি দেশ ছেড়ে যেতে পারবেন না। বিমানে ওঠার আগে এমন অভিযোগের কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। দিশাহারা যাত্রী আকুতি-মিনতি করতে থাকেন। এ অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজের নামে যাত্রীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।
বেল্টে লাগেজ উঠানোর সময় যাত্রীদের কাছে অল্প পরিমাণ অতিরিক্ত মালামাল থাকলেও শুরু হয় আরেক ধরনের হয়রানি। টাকা দিয়ে সমঝোতা করে তবেই বোর্ডিং পাস ইস্যু করাতে হয়, অন্যথায় মালামাল সেখানে ফেলে চলে যেতে হয় যাত্রীদের। বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের লাগেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে অযথা সময়ক্ষেপণ করানো হয়। সেখানে বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হিসেবে আলাদা কোনো কদরও মেলে না। সবাইকে এক পাল্লায় মেপে চলে অভিন্ন পাঁয়তারা। যাত্রীদের লাগেজ সংগ্রহের জন্য বেল্টের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করানোর ঘটনাও ঘটে। সময়ক্ষেপণের ফাঁকেই সংঘবদ্ধ চক্রটি লাগেজ গায়েব, লাগেজ কেটে ভিতরের মালামাল সরিয়ে নেয়। এ ছাড়া লাগেজ আসেনি বলে জানানো এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরে যোগাযোগ করার কথা বলে সাদা কাগজের চিরকুটে দায়িত্বরত কর্মকর্তার মোবাইল ফোন নম্বর লিখে দিয়েই যাত্রীকে বিদায় করা হয়। এর পর থেকে শুরু হয় হয়রানির নানা ধাপ। কয়েক দফা বিমানবন্দরে ঘোরাঘুরি করানোর একপর্যায়ে টাকা লেনদেনের বিনিময়ে লাগেজ দেওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে।
দুর্ভোগ বাড়ে অদক্ষতায় : বিমানবন্দরের বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। কেন্দ্রীয় সার্ভারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় যাবতীয় কর্মকাণ্ড। কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হলেও যথেষ্ট দক্ষ নন। তারা ধীরলয়ে কোনোমতে কাজকর্ম চালিয়ে নেন। ফলে যাত্রীদের প্রতীক্ষার প্রহর হয় দীর্ঘ। মেশিন রিডেবল পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র পরীক্ষায় অনেক সময় লাগে। পাশের দেশ ভারতের দিল্লি, পাকিস্তানের করাচি ও মিয়ানমারের ইয়াংগুনে একজন যাত্রীর কাগজপত্র পরীক্ষায় ৫-৭ মিনিট সময় লাগে। অথচ শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ২০-২৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন কর্মকর্তা জানান, অদক্ষ কর্মী দিয়ে কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থাপনা চালাতে গিয়ে ইমিগ্রেশন ছাড়পত্র শেষ করতে বেশির ভাগ সময়ই ফ্লাইট বিলম্বিত হয়। তাছাড়া ইমিগ্রেশনের পুরনো সার্ভারটির কর্মক্ষমতা হারানোর উপক্রম হয়েছে। বিদ্যুতের ভোল্টেজ ওঠানামাতেও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে সার্ভারটি। এ অবস্থায় একই সঙ্গে কয়েকটি ফ্লাইট উড্ডয়ন বা অবতরণ করলে বিমানবন্দরের গোটা ব্যবস্থাপনাই যেন ভেঙে পড়তে চায়। তখন যাত্রীদের প্রতীক্ষা আর ভোগান্তির শেষ থাকে না। এ ব্যাপারে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির এটিএস অ্যান্ড অ্যারোডম বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরে কর্মক্ষম ৪০টি ইমিগ্রেশন কাউন্টার আছে। কিন্তু লোকবলের অভাবে ১৪টি কাউন্টারই বন্ধ থাকে। ফলে অতিরিক্ত যাত্রীর ভিড় সামাল দিতে প্রায়ই ইমিগ্রেশন বিভাগকে হিমশিম খেতে হয়।
 যাত্রী হয়রানি কমাতে বিমানবন্দরে কাজ করছে ভ্রাম্যমাণ আদালতও। দোষী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া হচ্ছে শাস্তি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘যে কোনো যাত্রী ০১৮৬৬৫৪৪৪৪৪, ০১৮৬৬৫৬৬৬৬৬, ০১৭৮৭৬৬১১৪৪, ০১৭৮৭৬৬১১৬৬ নম্বরে কল করে বা ফেসবুক পেইজে (Magistrates, All Airports of Bangladesh ‡overnment) অভিযোগ জানালেই দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাচ্ছেন। লাগেজ হারানোর ক্ষেত্রেও মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থাপনায় যাত্রীরা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন।’

সর্বশেষ খবর