রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা
অবরোধে সহিংসতা

বার্ন ইউনিটের অশ্রু এখনো শুকায়নি

স্ত্রী ও এক বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে মো. খোকনের (২৮) ছোট সংসার। গুলিস্তানে প্লাস্টিকের জুতা বিক্রি করে ভালোই কাটছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী খোকনের। কিন্তু বিএনপির ডাকা অবরোধ খোকনের পরিবারের শান্তি কেড়ে নেয়। গত ২০ জানুয়ারি রাতে বাড়ি ফেরার পথে যাত্রাবাড়ীতে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় ঝলসে যায় খোকনের পুরো শরীর। তার ডান চোখের টিস্যু মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই চোখে তিনি কিছু দেখতে পান না। পেটে বড় ধরনের ঘা দগদগ করছে তার। সারা শরীর ব্যান্ডেজে মোড়া। কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার সংসার তছনছ হইয়া গেছে। সুস্থ হইলেও আর কোনো দিন কামে ফিরতে পারমু না। সন্তান ও বউরে কি খাওয়ামু!’ কথাগুলো বলতে বলতেই খোকনের দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। গতকাল দেখা যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পঞ্চম তলায় হরতাল ভিকটিমদের জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ডে খোকনের মতোই এখন মোট ১২ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে রোগীদের কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়। এদের মধ্যে কারও কারও অস্ত্রোপচার হচ্ছে আবার কারও হয়তো দু’একদিনের মধ্যেই হবে। চিকিৎসকরা আশা করছেন আগামী ১০-১২ দিনের মধ্যে সব রোগীই হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে পারবেন। দগ্ধদের ক্ষত ধীরে ধীরে শুকিয়ে এলেও তাদের অশ্রু শুকায়নি। আর অসহ্য ব্যথায় কাতর রোগীদের আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া হবে না বলেও বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের অবৈতনিক উপদেষ্টা সামান্ত লাল সেন।
জুতা ব্যবসায়ী খোকনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমার আগুনে তার শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে যায়। খোকনের সঙ্গে এখন হাসপাতালে অবস্থান করছেন তার স্ত্রী রত্না। এ দম্পতি জানান, সন্তানকে তারা তার নানীর কাছে রেখেছেন। কিন্তু এক বছর বয়সী ছোট্ট শিশুটি মাকে কাছে না পেয়ে ও মাতৃদুগ্ধ পান করতে না পেরে কান্নাকাটি করছে। খোকন জানান, খরচ কমাতে তিনি তার পরিবারকে নিয়ে ঢাকায় না থেকে নারায়ণগঞ্জে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু অবরোধের কারণে তাকে গত তিন মাস এ হাসপাতালে অবস্থান করতে হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা খরচ দেওয়া হলেও প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাওয়ার খরচ ইত্যাদির জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া অনুদানের টাকা খরচ করতে হচ্ছে। খোকন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার যে কাজ তার জন্য দুই হাত দরকার। কিন্তু আমি কিছুটা সুস্থ হলেও আর কাজে ফিরতে পারব না। সমাজের প্রতিষ্ঠিতদের কাছে আমি আগুনে পোড়া মানুষদের জন্য সহজ কোনো কাজ দেওয়ার অনুরোধ করছি।’ আর ছোট সন্তানের কথা বলতে গিয়ে কোনোমতে কান্না লুকিয়ে ফেলেন খোকনের স্ত্রী রত্না।
এদিকে সহিংসতায় রুবেল হোসেনের (২০) পরিবারেও অশান্তি নেমে এসেছে। রুবেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৯ মার্চ খুলনা যাওয়ার পথে চাঁদপুরের চন্দ্রায় তাদের ট্রাক লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারা হলে তার শরীরের ২৫ শতাংশ পুড়ে যায়। রুবেল জানান, তার বাবা ট্রাকচালক তাই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর পারিবারিক অর্থ সংকটের জন্য লেখাপড়া না করে পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতে তিনি ট্রাকের হেলপারি শুরু করেন। কিন্তু এ ঘটনার পর তার ৫ সদস্যের পরিবারে অন্ধকার নেমে এসেছে। হাসপাতালে রুবেলের পাশে থাকা মা ফরিদা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রুবেলের এ অবস্থার জন্য আমার সংসার বিপদে পড়ছে। ওর বাপের উপর চাপ পড়ছে কিন্তু তিনি একা সামলাইতে পারছেন না। ছেলের চিকিৎসার জন্য এরই মধ্যে দেড় লাখ টাকা খরচ হইছে।’ আর এ টাকা ফরিদা ধার করেছেন। তিনি আরও জানান, ছেলের চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে কোনো অনুদান এখনো পাননি। কথা বলার সময় ছেলের এবং নিজের সংসারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ফরিদার চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক ফুটে ওঠে। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে থাকেন রুবেলের মা। হরতাল ভিকটিম ওয়ার্ডে সবচেয়ে করুণ অবস্থায় দিন কাটছে খই বিক্রেতা শফিকুল ইসলামের (১৮)। গত ৩ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার থেকে নিজের পরিবারের কাছে আসার জন্য এই যুবক রাতের বাসে উঠেন; কিন্তু তাদের বাস লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা মারা হলে ঘুমন্ত অবস্থায় শফিকুলের শরীরের ২৮ শতাংশ পুড়ে যায়। আগুনে তার শ্বাসনালিও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি এখন আর কথা বলতে পারেন না। তীব্র ব্যথায় কান্নার শব্দের পরিবর্তে রুবেলের মুখে কেবল গোঙ্গানির শব্দ শোনা যায়। এ সময় পাশে থাকা স্বজনরা রুবেলের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছে দেন। বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, সারা শরীর ও মুখের চামড়া পোড়া দগদগে ঘা নিয়ে উল্টো হয়ে শফিকুল শুয়ে আছেন। মুখে সব সময় একটি পাইপ লাগিয়ে তাকে খাওয়ানো হচ্ছে। বোন ময়না জানান, তার ভাই এখন সোজা হয়ে শুতে পারে না। সম্প্রতি চিকিৎসকরা রুবেলের পায়ের চামড়া নিয়ে তার পিঠে বসিয়েছেন। জানা যায়, এ ঘটনার দেড় মাস আগে শফিকুলের মায়ের মৃত্যু হয়। মোট নয়জন পরিবারের সদস্য নিয়ে শফিকুল ঢাকায় থাকেন। তার আয়ে সংসারের খরচ ও ভাইদের লেখাপড়ার খরচ চালানো হতো। কিন্তু ছোট ভাইটির এ অবস্থা দেখে এখন বোন ময়না আশঙ্কা করছেন ভাইদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। সংসারের উপরও চাপ পড়বে।
রাজনৈতিক কারণে দগ্ধ হয়ে স্বপ্ন পুড়েছে সালাউদ্দিন ভূইয়া (৩০) নামের রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের এক বিক্রয় প্রতিনিধির। আড়াইহাজারের এই বাসিন্দা জানান, গত ২৩ জানুয়ারি দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে তার শরীরের ২৮ শতাংশ পুড়ে যায়। তার পুরো মুখমণ্ডল পুড়ে যাওয়ায় চোখের উপরের চামড়া বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি জানান, অনুদানের পুরো টাকা তার চিকিৎসায় খরচ হচ্ছে। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সালাউদ্দিন তার পুরো পরিবারের ব্যয় বহন করতেন। কিন্তু একমাত্র উপার্জনক্ষম এ ব্যক্তি এখন চিকিৎসাধীন হওয়ায় থমকে আছে পুরো সাত সদস্যের পরিবারের সাংসারিক খরচ। সালাউদ্দিনের স্ত্রী উর্মি এ প্রতিবেদককে জানান, স্বামীর এ অবস্থার জন্য তার দুই ছেলে আবিদ ও হামিদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা বড় ছেলে আবিদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে ভরা গলায় সালাউদ্দিন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমি ভালো না হলে ওদের কী হবে?

সর্বশেষ খবর