শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

সিএনজি-ট্যাক্সি ক্যাবের নৈরাজ্য

ঢাকাবাসীর ভোগান্তি চরমে

সিএনজি-ট্যাক্সি ক্যাবের নৈরাজ্য

ট্যাক্সি ক্যাব ও সিএনজি অটোরিকশার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে নগরবাসী। গণপরিবহন সংকটের এই সময়ে ভাড়ার বাহুল্যে ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিস মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। মানুষ খুব বাধ্য না হলে এখন ট্যাক্সি ক্যাবে চড়তেই চান না। অন্যদিকে সিএনজি অটোরিকশাও যাত্রী হয়রানি, ভাড়া নৈরাজ্যে এক ধাপ এগিয়ে। মানুষ সিএনজিতেও চড়েন বাধ্য হয়ে, বিকল্প কোনো উপায় না থাকায়। এই দুই সার্ভিস নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে রাজধানীবাসী। নগর পরিবহনে স্বস্তির জন্যে ১৯৯৭ সালে ১১ হাজার ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে যে সার্ভিসের সূচনা হয়েছিল ১৮ বছর পর তার প্রায় সবই রাস্তা থেকে উঠে গেছে। এখন দীর্ঘ অপেক্ষার পরও রাস্তায় ক্যাব মিলে না। বরং ট্যাক্সি ক্যাব বলতে গত বছরের এপ্রিলে চালু হওয়া দুই কোম্পানির সাকুল্যে ৩৫০টি ক্যাবই রাস্তায় চলছে। ভাড়া আধিক্যের কারণে ক্যাব সার্ভিসটি জনপ্রিয় না হওয়ায় নতুন ট্যাক্সি ক্যাব নামাতে পারছেন না উদ্যোক্তারা।

গত বছরের ২২ এপ্রিল রাজধানীতে নতুন ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিসের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতে আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ২৭টি এবং তমা কনস্ট্রাকশনের ১৯টি ক্যাব রাস্তায় নামে। এর আগে গত বছরের ২৩ মার্চ যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নতুন ট্যাক্সি ক্যাবের জন্য প্রথম ২ কিলোমিটার ১০০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ৩৪ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে, যা আগে ছিল ৬০ টাকা এবং ১৫ টাকা। সার্ভিসের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী প্রথম দুই কিলোমিটার ১০০ টাকার পরিবর্তে ৮৫ টাকা নির্ধারণের নির্দেশ দেন। তারপরও এই ভাড়ার হার এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। কোনো কোনো শহরের চেয়ে তিন গুণ। ঢাকায় যেখানে ট্যাক্সিতে উঠলেই ৮৫ টাকা গুনতে হয়, সেখানে কলকাতায় প্রতি কিলোমিটার ৩১.৬৫ টাকা, কলম্বোয় ২৯.৯৫ আর ব্যাংককে ৮১.৭৯ টাকা। অন্যদিকে ফোন করে ট্যাক্সি ডাকলে যে জায়গা থেকে ট্যাক্সি আসবে সেই জায়গা থেকেই মিটার অন করবে ড্রাইভার। অর্থাৎ যানজটের এই নগরীতে ট্যাক্সিতে চড়ার আগেই দেখা যায় মিটারে দুই-তিনশ টাকা বিল উঠে গেছে। এ ছাড়া যাত্রা বিরতিকালে প্রতি দুই মিনিটের জন্য সাড়ে ৮ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। অর্থাৎ যানজটে পথে ৮ মিনিট আটকে থাকলে এক কিলোমিটারের ভাড়া দিতে হবে। মিরপুরের বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন বলেন, বিপদে আপদে সিএনজি অটোরিকশা বা ট্যাক্সি ক্যাবের দরকার পড়ে। এখন দেখছি এই সার্ভিসই বড় আপদ হয়ে পড়েছে। ট্যাক্সি সার্ভিসের এত ভাড়া হওয়া মোটেই উচিত নয়। অন্যদিকে ওয়েটিং চার্জও অনেক বেশি। একবার ক্যাবে চড়লে ৫০০-৬০০ টাকার কমে নামা যায় না।

রাজধানীতে বর্তমানে দিনে সর্বোচ্চ ৩০০ ট্যাক্সি ক্যাব চলাচল করে। এর মধ্যে আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বহরে ১০০টি ও তমা কনস্ট্রাশনের বহরে ২৫০টি ক্যাব রয়েছে। গত শনিবার রাজধানীতে তমার ক্যাব চলেছে ১৯৯টি। উত্তরার ব্যাংক কর্মকর্তা ইব্রাহিম মণ্ডল বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ট্যাক্সি ক্যাবের ভাড়া থাকে মানুষের নাগালের মধ্যে। আমরা ঢাকার ট্যাক্সির এই ভাড়া এফোর্ড করতে পারছি না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ'র একজন উপপরিচালক বলেন, ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিস মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে জনপ্রিয় হবে না। আর জনপ্রিয় না হলে এটি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। লাভজনক না হলে রাস্তায় বেশি সংখ্যায় ক্যাব নামারও কোনো লক্ষণ দেখছি না।

সিএনজিতে হয়রানি চরমে : রাজধানীতে চলাচলকারী প্রায় ১৪ হাজার সিএনজি অটোরিকশার চালকের কাছে যাত্রী হয়রানি চরমে। নির্ধারিত মিটারে যাত্রী পরিবহনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সিএনজিচালকরা চুক্তি ভাড়াতেই যাত্রী পরিবহন করে। বাহনটিতে 'মিটার' নামে একটি ডিভাইস যে যুক্ত করা আছে সেটিই ভুলে গেছেন চালকরা। অন্যদিকে নিজেদের প্রয়োজনের কথা ভেবে যাত্রীরাও সেকথা স্মরণ করতে চান না। বরং চালক যে ভাড়া হাঁকেন সেই ভাড়াতেই গন্তব্যে যেতে রাজি তারা। হরতাল, অবরোধে, ঝড়, বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে পড়া মানুষের কাছে একটি সিএনজি পাওয়াই বড় আনন্দের। যারা পাবলিক বাসে চলাচলে অভ্যস্ত নন এবং নারী, শিশু, বয়স্ক ও রোগীদের নির্ভরতাকে পুঁজি করেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজধানীর সিএনজি অটোচালকরা। পিক আওয়ারে তারা অনেক সময় দ্বিগুণ ভাড়া নিয়ে গন্তব্যে যান। এসব নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যায় না। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের সার্জেন্টরাই এখন সিএনজি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীর 'দ' সিরিয়ালের অধিকাংশ প্রাইভেট সিএনজির মালিক ট্রাফিক সার্জেন্ট। এ জন্য রাস্তার পুলিশ এখন সিএনজির ব্যাপারে অনেক নমনীয়। ব্যক্তিগত ব্যবহারের উদ্দেশে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া 'দ' সিরিয়ালের প্রায় ৭০০ সিএনজির ৮০ ভাগই রং পাল্টে সবুজ করে এখন বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন করছে। কোনো কোনো সার্জেন্টের কয়েকটি করে সিএনজি রয়েছে। সূত্র জানায়, যাত্রী হয়রানি আর ভাড়া নৈরাজ্যে সিএনজি অটোরিকশা সবচেয়ে এগিয়ে। এ জন্য বর্তমানে ঢাকার রেজিস্ট্রেশন নেওয়া সিএনজি অটোর হাতবদল হচ্ছে ১৫ লাখ টাকায়। রাজধানীতে যাত্রীবাহী বাসের স্বল্পতার কারণে যাত্রীদের সিএনজি নির্ভরতা এখন অনেক বেশি। পিক আওয়ারে কোনো স্টপেজে একটি সিএনজি এসে থামলে একসঙ্গে অনেক যাত্রী ভিড় করে। এই সুযোগে তারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। মানুষ বাধ্য হয়ে বাড়তি ভাড়া দিয়েই গন্তব্যে যায়। অন্যদিকে পুলিশ সার্জেন্টরা সিএনজি অটোর মালিক হয়ে যাওয়ায় রাজধানীর রাজপথে সিএনজি অটোর বিরুদ্ধে পুলিশি তৎপরতা এখন সীমিত। এ ছাড়া সিএনজি চালকদের এখন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো গন্তব্যে যেতে বাধ্য করা যায় না। অথচ সিএনজি অটোরিকশার নীতিমালায় বলা হয়, চালকরা সিটি এলাকার মধ্যে যে কোনো গন্তব্যে যাত্রীকে নিয়ে যেতে বাধ্য থাকবেন। এই নীতিমালা এখন শুধু যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের গেজেটেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সারা দিন শত শত যাত্রী প্রত্যাখ্যান করেন চালক। অন্যদিকে ভাড়ার ব্যাপারেও স্বেচ্ছাচারিতা ক্রমেই বাড়ছে।

ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দীন বলেন, রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে না পারলে যাত্রীদের এই জিম্মি দশা দূর হবে না। এর মধ্যে বিআরটি (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) ও মেট্রো রেল চালু হলে অবস্থার অনেক পরিবর্তন আসবে। সেই পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

 

সর্বশেষ খবর