শনিবার, ২৩ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

রেলের ভূমি দখলে প্রতিযোগিতা

পশ্চিমাঞ্চলেই ৩ হাজার একর ভূমি বেহাত

রেলের ভূমি দখলে প্রতিযোগিতা

রেলের ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে লাগামহীন দুর্নীতি। রেলওয়ের কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তার যোগসাজশে রেলের ভূমি দখলে চলছে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় শীর্ষে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে রেলের জমি দখলের এই প্রতিযোগিতায় গত ৪৩ বছরে বেহাত হয়ে গেছে প্রায় ৪ হাজার ৪৬৫ দশমিক ৬২ একর জমি। এর মধ্যে শুধু পশ্চিমাঞ্চলেই দখল হয়েছে ৩ হাজার ৩৮৭ দশমিক ২৭ একর। আর পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৭৮ দশমিক ১৫ একর। সরকারি হিসেবেই উঠে এসেছে এই চিত্র। প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে আরও ভয়াবহ বলে দাবি করেছেন রেলের ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত নানা সূত্র। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে খাতা-কলমে লিজ বা ইজারা দেওয়া আছে ১২ হাজার ৭২১ দশমিক ৪ একর জমি। ইজারা দেওয়া জমি থেকে রেলওয়ের বার্ষিক আয় হওয়ার কথা বছরে ১৮ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র তিন বছরে রেলের ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও অনিয়মের ফলে ১৪৫ কোটি ৭২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে বলে রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট পেশ করেছে সরকারের অডিট মহাঅধিদফতর। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য পাঠিয়ে দেয় সরকারের হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। কমিটি রেলওয়ের এই ব্যাপক অনিয়মে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিন মাসের মধ্যে উক্ত বকেয়া টাকা আদায় করে অবিলম্বে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ রেলওয়ের পাকশী ও লালমনিরহাট কার্যালয়ের ২০০৭-০৮ হতে ২০১০ অর্থ বছরের জমি ব্যবস্থাপনা ও লাইসেন্স আদায় সংক্রান্ত নিরীক্ষাকালে পরিলক্ষিত হয় যে, পশ্চিমাঞ্চলের ৩৩৮৭.২৭৪৯ একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। যার পরিমাণ ১৪৫ কোটি ৭২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এই অবৈধ দখলদারদের মধ্যে সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তি পর্যায় রয়েছে। বিধি মোতাবেক উক্ত জমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে লাইসেন্স দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা প্রতিপালিত হয়নি। এক্ষেত্রে রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, 'অবৈধ দখলদারদের দখলে থাকা রেলভূমি পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। প্রতি মাসে কমপক্ষে ৪টি উচ্ছেদ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়'। রেলের পাকশী ও লালমনিরহাট বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, 'উচ্ছেদ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার আওতায় উচ্ছেদ করা হয় এবং উচ্ছেদকৃত খালি জায়গায় বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট এসএসএই/কার্য ও স্টেশন মাস্টারদের উচ্ছেদকৃত খালি জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও মামলা মোকাদ্দমার কারণে অনেক রেলভূমি অবৈধদের দখলে থেকে যাচ্ছে। মামলায় রায় পাওয়া সাপেক্ষ অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে'। অবাক করা ব্যাপার হলো- রেলওয়ের স্থানীয় ভূসম্পত্তি বিভাগের এই বক্তব্যের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে রেলওয়ের মহাপরিচালকসহ খোদ রেল মন্ত্রণালয়। রেলওয়ের ভূমি দখলের বিষয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, 'অবৈধভাবে দখলকৃত ভূমি উদ্ধারের কাজ চলছে। রেলের সম্পদ রেলে ফিরিয়ে আনা হবে। অবৈধভাবে দখল করা ভূমি উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান চলছে'। তবে নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় রেল কর্তৃপক্ষের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন, 'উচ্ছেদের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণসহ জবাব প্রদান করা হয়নি। প্রতিবেদন হতে দেখা যায় যে, রেলওয়ের ভূমি দখলের প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্ছেদ কার্য পরিচালনা করা হলেও সংরক্ষণের অভাবে পরক্ষণেই দখলদারদের দখলে চলে যায়। ফলে উচ্ছেদ কার্যক্রমের ফলাফল শূন্য'। এসবই সরকারি বক্তব্য। রেলওয়ে অডিট অধিদফতরের মহাপরিচালক নূরুন নাহার এ অডিট রিপোর্টে স্বাক্ষর করেন গত ২ এপ্রিল। সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে রিপোর্টটি নিয়ে আলোচনা হয় গত ৭ মে। কমিটি অবৈধ জমি দখল মুক্ত করা, তিন মাসের মধ্যে অনাদায়ী টাকা আদায়, ইজারার হার সংশোধন, দায়েরকৃত মামলার তদবির জোরদার এবং আদায়কৃত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে প্রমাণক জমা করে অডিট নিষ্পত্তির সুপারিশ করে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রেলের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে জমি দখলসহ মামলা মোকাদ্দমার ঘটনা ঘটছে। দখলি জায়গায় গড়ে উঠছে মার্কেট, কাঁচাবাজার, স'মিলসহ নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এসবের সঙ্গে বেনামে জড়িত আছে অসাধু অনেকে। এ ছাড়া রেলের জমি লিজ দেওয়ার পর ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে লিজ জমিকে নিজ দখলি জমি হিসেবে দাবিনামা পেশ করে মামলা করার ক্ষেত্রে স্থানীয় ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ের জমির সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে সরেজমিন জরিপ করে ২০০৭ সালে প্রতিবেদন প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু দুই বছরের কাজ আট বছরেও শেষ করতে পারেনি তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেলের জমি ব্যবহারে সরকারের কোনো পরিকল্পনা না থাকায় রেলের জমির পরিমাণও দিন দিন কমছে। বর্তমানে রেলের দখলে অব্যবহৃত জমি রয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ১০৭ একর। এর মধ্যে কৃষি জমি ১০ হাজার ৭১৬ দশমিক ৮১ একর। বাংলাদেশ রেলওয়ের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে রেলওয়ের মালিকানাধীন জমি রয়েছে প্রায় ৬১ হাজার ৬০৫ দশমিক ৮৪ একর। এর মধ্যে রেলওয়ে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে ৩১ হাজার ৩১১ দশমিক ৫০ একর জমি। এ ছাড়া ৭৯৫ দশমিক ১৯ একর মৎস্য, ৩০ দশমিক ৫৫ একর নার্সারি, ১২ দশমিক ৪৭ একর সিএনজি, ৪৫ দশমিক ৬৭ একর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ২১০ দশমিক ৬৯ একর সরকারি-আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছে লাইসেন্সের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া আছে।

বাণিজ্যিক লাইসেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে ৯০৯ দশমিক ৮৪ একর জমি।

 

 

সর্বশেষ খবর