শনিবার, ২৩ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
চাঞ্চল্যকর সেসব খুন ১৬

ব্রাশফায়ারে মুহূর্তেই আট লাশ

ব্রাশফায়ারে মুহূর্তেই আট লাশ

সাদা রংয়ের মাইক্রোবাসটি শহরের অাঁকাবাঁকা পথে ছুঁটে চলছে। তার পিছু নিয়েছে নীল রংয়ের অপর একটি মাইক্রোবাস। হঠাৎ পেছনের চলন্ত মাইক্রোবাসের ডান দিকের সাইড দরজা খুলে যায়। ভারী অস্ত্র হাতে এক যুবক খোলা দরজা দিয়ে মাথা বের করে দিয়েছে। একই সময়ে চালকের বাম দিকে বসা আরেক যুবকও জানালা দিয়ে দেহের অর্ধেক বের করে বসেছে। তার হাতেও ভারী অস্ত্র। হঠাৎ তাদের অস্ত্রগুলো হিংস্র হয়ে ওঠে। সামনে ছুটে চলা মাইক্রোবাস লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পেছনের গ্লাস ভেঙে যায়। চাকা ফুটো হয়। সাদা মাইক্রোবাসটি থেমে যায়। অস্ত্রধারীদের বহন করা নীল মাইক্রোবাসটি পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়ায়। দ্রুতগতিতে ৩/৪ জন যুবক মাইক্রোবাস থেকে নেমে আসে। প্রত্যেকের হাতেই স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র! তারা সাদা মাইক্রোবাস ঘিরে ফেলে। অস্ত্রের ট্রিগারে চাপ দেয়। ম্যাগজিনের গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ট্রিগার থেকে আঙ্গুল সরায় না তারা। সাদা মাইক্রোবাসের ভিতরটা ততক্ষণে রক্তে ভেসে গেছে। একজন আরেকজনের ওপর মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। একজন দরজা খুলে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। মাত্র ৬ মিনিটেই মাইক্রোবাসে পড়ে থাকে আটটি লাশ।

এটি কোনো চলচ্চিত্রের শুটিং নয় বা অ্যাকশন মুভির কোনো অংশ নয়। ১৫ বছর আগে চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাটের বহদ্দারবাড়ির সামনে ঠিক এভাবেই ফিল্মি কায়দায় আট খুনের ঘটনা ঘটেছিল। দিনের আলোয় শত শত লোকের সামনে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অস্ত্রধারীরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। তৎকালীন সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বহনকারী মাইক্রোবাস এই হামলার শিকার হয়। জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা এই হামলা চালায়। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এ সময় বাকলিয়ায় ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। ২০০০ সালের ১২ জুলাই সংঘটিত নজিরবিহীন এই হত্যাযজ্ঞে চট্টগ্রামকে পরিণত করেছিল আতঙ্কের নগরীতে। জামায়াত-শিবিরের এই নৃশংসতাকে অনেকেই ২৫ মার্চ কালরাতের নৃশংসতার সঙ্গে তুলনা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের এই তাণ্ডবলীলায় মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। দিনের বেলায় একটি মাইক্রোবাস দিয়ে আরেকটি মাইক্রোবাসকে অনুসরণের পর ব্রাশ ফায়ার করে আট খুনের ঘটনা নজিরবিহীন বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী। ফিল্মি স্টাইলে এমন হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় পুলিশ ও গোয়েন্দারা হতবাক। শত শত মানুষের সামনে রক্তাক্ত হওয়া চট্টগ্রামের খবর জানতে তখন পত্রিকা অফিসগুলোতে একের পর এক ফোন আসতে থাকে। এ ঘটনায় নিহতদের একজনের ভাই আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার কালামিয়ার বাজারে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের এক সমাবেশে যাওয়ার পথে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ছাত্রলীগের ছয় নেতা, তাদের মাইক্রোবাসের চালক ও একজন অটোরিকশার চালক নিহত হন। ঘটনার আট বছর পর ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ মামলাটির রায় দেন চট্টগ্রামের দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ একরামুল হক চৌধুরী। রায়ে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন খান, মো. আলমগীর কবির ওরফে বাট্টা আলমগীর, মো. আজম ও মো. সোলায়মানকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এ ছাড়া আরও তিনজন শিবির ক্যাডার হাবিব খান, এনামুল হক ও আবদুল কাইয়ুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা এখনো পলাতক। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সাজ্জাদ হোসেন খান ভারতের কারাগারে, অন্য তিনজন দেশের কারাগারে বন্দী। পরবর্তীতে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে চার আসামিকে খালাস দিয়ে রায় দেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার কালামিয়ার বাজারে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের এক সমাবেশ ছিল। নাসিরাবাদ শেরশাহ কলোনি থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেই সমাবেশে যোগ দিতে মাইক্রোবাসে রওনা হন। বেলা ১১টায় তারা কলোনি থেকে বের হওয়ার পর থেকেই নীল রংয়ের একটি মাইক্রোবাস অনুসরণ করতে থাকে। ছাত্রলীগের মাইক্রোটি শিবির অধ্যুষিত বহদ্দারহাট অতিক্রম করার সময় নীল মাইক্রো থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। ছাত্রলীগের মাইক্রোটি থেমে গেলে শিবির ক্যাডাররা ছাত্রলীগের মাইক্রোবাসের সামনে গিয়ে গুলি চালাতে থাকে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও চালক। এ সময় পাশের একটি অটোরিকশা চালকও গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়েন। একনাগাড়ে গুলির বিকট শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন মাটিতে শুয়ে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করে। কেউ কেউ পাশের একটি পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরাপদে চলে যান। দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তা ফাঁকা। মাত্র পাঁচ মিনিটেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অস্ত্রধারীরা আবারও নীল মাইক্রোবাসে চড়ে বসে। ওমর আলী মাতব্বর লেইন ধরে কক্সবাজারের দিকে অস্ত্রধারীরা পালিয়ে যায়। ঘটনার ১৫ মিনিট পর পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। নিহতরা হলেন, কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট ছাত্র সংসদের সাবেক সহসভাপতি হাসিবুর রহমান হেলাল, এজিএস রফিকুল ইসলাম সোহাগ, ইনস্টেটিউটের ছাত্র জাহাঙ্গীর হোসেন, বায়েজিদ বোস্তামী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, শেরশাহ কলেজ ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আবুল কাশেম, জাহিদ হোসেন এরশাদ, মাইক্রোবাস চালক মনু মিয়া এবং অটোরিকশা চালক কাশেম।

 

সর্বশেষ খবর