বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

দুর্ভোগেই যাত্রা শুরু

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তীব্র যানজট

দুর্ভোগেই যাত্রা শুরু

দুর্ভোগ আর ভোগান্তি নিয়েই ঘরে ফিরছে মানুষ। রাজধানীর সদরঘাট থেকে তোলা গতকালের ছবি -রোহেত রাজীব

মুষলধারে বৃষ্টি, বিভিন্ন পয়েন্টে তীব্র যানজটসহ সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে শুরু হয়েছে ‘ঈদযাত্রা’। গতকাল সকাল থেকে কালো মেঘে ঝুমবৃষ্টি বাদ সেধেছে। তবু থেমে নেই ঘরমুখো মানুষ। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই নাড়ির টানে ঘরে ফিরছেন তারা। শবেকদরের রাত পেরিয়েছে। ঈদ একেবারে দুয়ারে। এবার ধরতে হবে বাড়ির গাড়ি। ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ভোর থেকেই বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, ট্রেনস্টেশনে যাত্রীদের ভিড় জমে উঠেছে। যারা আগে টিকিট সংগ্রহ করতে পেরেছেন তারা নিশ্চিন্তে পরিবার-পরিজন নিয়ে সিটে বসেই রওনা হয়েছেন গন্তব্যে। টিকিট সংগ্রহ করতে যারা ব্যর্থ হয়েছেন তারাও থেমে থাকেননি। ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়েই ছুটে গেছেন বাস টার্মিনাল, লঞ্চস্টেশনে। বৃষ্টির মধ্যে পলিথিনের কাগজে দেহ ঢেকে বাড়িমুখো মানুষজন উঠে বসেছেন বাস-ট্রেনের ছাদে ছাদে। কেউ কেউ বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে রওনা হয়েছেন বাড়ির পথে। সকাল থেকেই নামছে মুষলধারে বৃষ্টি। আবহাওয়া অফিস এরই মধ্যে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত জারি করেছে। তাতে কি! ঈদে তো বাড়ি যেতেই হবে। তাই বৈরী আবহাওয়াতেও থেমে নেই ঈদযাত্রা।
বরিশাল, চাঁদপুর, পুটয়াখালী, ঝালকাঠি, বরগুনা, পিরোজপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলে ঘরমুখো মানুষের চাপ সামলাতে ঈদযাত্রায় স্পেশাল লঞ্চ সার্ভিস শুরু হয়েছে ১৪ জুলাই থেকে। এ সার্ভিসকে আরও নিরাপদ করতে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বিশেষ সার্ভিসসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে ৮২টি লঞ্চ ঢাকা ছেড়ে গেলেও গতকাল ৯০ থেকে ৯৫টি সদরঘাট ছেড়ে গিয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রীর কড়া নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার বিধিনিষেধ মানছেন না মুনাফালোভী মালিকরা। বৃষ্টির কারণে দুপুরের দিকে নৌ-টার্মিনালে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকলেও বিকেল থেকে ভিড় বাড়তে থাকে। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় যেতে মহাখালী বাস টার্মিনালে ভিড় জমিয়েছিলেন ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। অন্য দিনের তুলনায় ভিড়ও বেশি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই খুশিমনে যাত্রীরা পাড়ি জমিয়েছেন গন্তব্যে। একই অবস্থা গাবতলী বাস টার্মিনালের। তবে বৃষ্টির কারণে কমবেশি শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে বলে জানালেন যাত্রীরা। শিডিউল বিপর্যয়ের বিষয়ে হানিফ পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার এম রানা বলেন, ‘আজ সকাল থেকে বৃষ্টির কারণে যাত্রীদের কাউন্টারে পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। ফলে কিছুটা বিলম্ব করেই ছাড়তে হচ্ছে বাস।’ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বৃষ্টি বিড়ম্বনার কথা। মাগুরার যাত্রী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার বিকাশ পরিবহনের টিকিট নিয়েছি আগেই। আজ সকালে বৃষ্টির কারণে বাসা থেকে বের হতে পারছিলাম না। এর মধ্যে সুপারভাইজার ফোন করেছেন। তাই ভিজেই চলে এসেছি।’ গতকাল সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। বৃহস্পতিবারের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে কেউ, আবার কেউ ছুটি ছাড়াই বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছেন। তাদের পোহাতে হয়েছে পদে পদে ভোগান্তি। অসহনীয় যানজট, মারাত্মক পরিবহন সংকট, যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, হয়রানি, মালামাল নিয়ে কুলিদের টানাটানি, যাত্রীদের নিয়ে বাসশ্রমিকদের টানাহেঁচড়া, পকেটমার ও মলম পার্টির দৌরাত্ম্যে-এমন নানা ভোগান্তি হাসিমুখে মেনে নিয়েই ছুটছে মানুষ আপন ভুবনে। ফলে সকাল থেকেই রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর, শ্যামলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ও কমলাপুর রেলস্টেশনে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে। এদিকে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার মেঘনা এলাকায় গোমতী সেতুর ওপর চাকা ফেটে চট্টগ্রামগামী মালবাহী ট্রাক বিকল হওয়ায় এক পাশের লেন বন্ধ হয়ে যায়। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বুধবার ভোর ৫টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ফলে মহাসড়কে বিপুলসংখ্যক গাড়ি আটকে যায়। বেলা ১১টা পর্যন্ত দাউদকান্দির হাসানপুর থেকে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনা সেতু এলাকা পর্যন্ত প্রায় ২২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত (ইনচার্জ) কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ঈদ সামনে রেখে যানবাহনের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে সরু গোমতী সেতুতে সকালে ট্রাক বিকল হওয়ায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। দিনভর যানজটে ঘরমুখো যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। গতকাল কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে স্টেশন চত্বর আর প্ল্যাটফর্মে ঘরমুখো মানুষের স্রোত। সব বয়সী মানুষ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। স্টেশনে ট্রেন পৌঁছামাত্র সেদিকে ছুটে যাচ্ছে তারা। দেখা গেছে, কমলাপুর স্টেশনে প্রতিটি ট্রেনেই অতিরিক্ত যাত্রী উঠেছে। ছাদে, ইঞ্জিনে, দরজার হাতলে ঝুলে ছুটছে মানুষ। অনেকে জীবনে ঝুঁকি নিয়ে দুই বগির সংযোগস্থলে বসেও ছুটছেন প্রিয় গন্তব্যে। চট্টগ্রামগামী যাত্রী আকলিমা আক্তার অভিযোগ করেন, অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে টিকিট কেটেও সিটে বসা যাচ্ছে না। যাত্রীর ভিড়ে সিট খোঁজা মুশকিল। এ ছাড়া ভিড়ের কারণে নারী যাত্রীরা টয়লেট ব্যবহার করতে পারছেন না। কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন চত্বরে কালোবাজারিদের টিকিট বিক্রি করতে দেখা গেছে। চট্টগ্রামগামী যাত্রী মামুনুর রশিদ বলেন, ‘কী আর করব। কাউন্টার থেকে টিকিট পাইনি। দালালদের কাছ থেকে বেশি দাম দিয়ে টিকিট কিনেছি।’ চট্টগ্রামের দুটি এসি চেয়ার টিকিট তিনি তিন হাজার ২০০ টাকায় কিনেছেন। বেশি দাম দিয়ে টিকিট কিনলেও তিনি খুশি। অতিরিক্ত গাড়ির চাপে ঢাকা-আরিচা, নবীনগর-কালিয়াকৈর ও আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ঘরমুখো মানুষ। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ ছাড়াও সড়কের বেহাল দশা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো এবং যেখানে-সেখানে পার্ক করার কারণে এ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বুধবার ভোররাত থেকে শুরু হওয়া যানজটে সড়কগুলোতে থেমে থেমে যানবাহন চলতে দেখা গেছে। যানজট নিরসনে পুলিশের পাশাপাশি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু সড়কে কালিহাতীর এলেঙ্গা থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিমি রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের অতিরিক্ত চাপে এ যানজট শুরু হয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সংযোগস্থল পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীসাধারণ। গতকাল ভোর থেকেই শুরু হয় এই জট। পাটুরিয়া ঘাট থেকে শিবালয়ের উথুলি বাসস্ট্যান্ড এলাকা পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ সাত কিলোমিটার যানজট ছাড়িয়েছে। রাজধানীর গাবতলী ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে তিন-চার ঘণ্টা পর গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে বাস। অনেকে সিট না পেয়ে ছাদে উঠেছেন।
ভিড় নেই সায়েদাবাদে : সব টার্মিনাল, রেলস্টেশন, নৌ-টার্মিনাল যাত্রী ভিড়ে ঠাসা থাকলেও ব্যতিক্রম চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত সেখানে যাত্রীদের তেমন একটা ভিড় দেখা যায়নি। বাস-মিনিবাসও চলাচল করছে স্বাভাবিক নিয়মে। কাউন্টার মাস্টাররা বসে অলস সময় পার করছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কোনো কাউন্টারেই যাত্রীদের চাপ নেই। নিয়মিত যেমন, তেমনই আসছেন সাধারণ যাত্রী। টিকিট নিচ্ছেন আর বাসে উঠে রওনা হচ্ছেন গন্তব্যে।
কাওড়াকান্দি-শিমুলিয়া নৌরুট : মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার কাওড়াকান্দি-শিমুলিয়া নৌরুটে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে যাত্রী ও পরিবহনের চাপে ফেরিঘাট থেকে পাঁচ্চর বাজার পর্যন্ত তিন কিলোমিটার যানজট তৈরি হয়েছে। গতকাল ভোর থেকেই কাওড়াকান্দি ঘাটে ফেরি, স্পিডবোট ও লঞ্চে যাত্রীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। লঞ্চ, স্পিডবোট ও ফেরিতে পার হয়ে আসা যাত্রীদের অনেককেই গাড়ির ছাদে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। কাওড়াকান্দি নেমে অনেক দূর হেঁটে পরিবহনে উঠতে হচ্ছে যাত্রীদের। বাসে সিট কিংবা দাঁড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে ঝুঁকি নিয়ে ছাদে চড়েই বাড়ি যাচ্ছেন অনেকে। সকাল থেকে কাওড়াকান্দি-শিমুলিয়া নৌরুটে পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার বন্ধ রেখেছে ঘাট কর্তৃপক্ষ।
লঞ্চে অতিরিক্ত ভাড়া : সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া পটুয়াখালীগামী সব ডাবল ডেকার যাত্রীবাহী লঞ্চের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে লঞ্চের স্টাফদের সঙ্গে যাত্রীদের বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। হাতাহাতি পর্যায়েও গড়াচ্ছে। পটুয়াখালীগামী কুয়াকাটা-১ লঞ্চের যাত্রীরা জানান, দুই দিন আগেও পটুয়াখালী থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে পটুয়াখালীগামী যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হয়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকেই ৩০০ বা ৩৫০ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নিরাপত্তার চাদরে সদরঘাট : সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালসহ আশপাশ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তুলেছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা-বলয়। ?বিভিন্ন স্থানে লাগানো হয়েছে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা। যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সদরঘাটমুখী যাত্রীদের চলাচলের রাস্তা নির্বিঘ্ন করতে দখলমুক্ত করা হয়েছে ফুটপাত। কোনো কেনো রাস্তার ট্রাফিক-ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে করা হয়েছে একমুখী। মূল রাস্তার ওপর যাতে কেউ গাড়ি পার্ক করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছে পুলিশ। এদিকে যাত্রীদের পথ চেনাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বিএনসিসির সদস্যদের কার্যক্রম লক্ষ করা গেছে।
গাজীপুরে ১৫০০ পুলিশ : গাজীপুর থেকে খায়রুল ইসলাম জানান, এবার মহাসড়ক প্রশস্তকরণ ও পুলিশের তদারকিতে এবারের ঈদে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর