মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর

বদলে যাচ্ছে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর

বদলে যাচ্ছে দেশের সর্ব উত্তরের উপজেলা তেঁতুুলিয়ার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। যান চলাচলের পাশাপাশি এই স্থলবন্দর দিয়ে চার দেশের ব্যবসায়ীরা গমনাগমন করতে পারবেন। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলেই শুরু হবে পণ্য আমদানি-রপ্তানি। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী চার দেশের ব্যবসায়ীরাও যাতায়াত করতে পারবেন। এতে আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি তেঁতুলিয়ায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। সৃষ্টি হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত। সড়কযোগে চীনে যাতায়াতের পথও উন্মুক্ত হবে।
গত ১৫ মে ভুটানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভারত, নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে সরাসরি গাড়ি প্রবেশের একটি চুক্তি সই করেছেন। আগামী জানুয়ারিতে এ কার্যক্রম শুরু হবে। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, তার আগেই ইমিগ্রেশন চালু হবে।
এ প্রসঙ্গে পঞ্চগড় জেলা পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সব দেশই প্রস্তুত রয়েছে। ইমিগ্রেশনের ঘোষণা এলেই কার্যক্রম শুরু হবে।’
জানা গেছে, ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময় কার্যক্রম শেষ হলেই এই বন্দরের ইমিগ্রেশন চালুর ঘোষণা আসতে পারে। স্থানীয় অধিবাসীরা এ সুযোগের অপেক্ষা করছেন। তেঁতুলিয়াবাসী আশা করছে, অল্প কিছু দিনের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও যাতায়াতের পথ উন্মুক্ত হবে। এতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে থাকা মানুষের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। পঞ্চগড়ে বসবাসকারী মানুষের প্রায় অর্ধেকের ভারতের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। ’৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় অধিকাংশ মানুষ ভারতে আত্মীয়স্বজন রেখে বাংলাদেশে চলে আসে। এ প্রসঙ্গে ইতিহাস গবেষক আহসান হাবিব জানান, ‘পঞ্চগড়ের ৫০ ভাগ মানুষ দেশভাগের সময় ভারত থেকে এ দেশে এসেছে। সে  দেশে তাদের অনেক আত্মীয়স্বজন থাকলেও দেখা করার উপায় নেই। ইমিগ্রেশন চালু হলে উভয় দেশ থেকেই বিপুল পরিমাণ মানুষ আত্মীয়স্বজনকে দেখতে আসবে এবং ভারতেও যাবে।’ এদিকে বাংলাবান্ধা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ইমিগ্রেশনকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের প্রস্তুতি চলছে। তবে কার্যক্রমে কিছুটা ধীরগতি। স্থানীয়রা জানান, বাংলাদেশে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম কিছুটা ধীরগতি হলেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে এর কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে।
বাংলাবান্ধায় ১৯৯৭ সালে স্থলবন্দর চালু হয়। স্থলবন্দর উদ্বোধনের দিন থেকে জেলাবাসী ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু ১৯ বছরেও সে দাবি পূরণ হয়নি। বন্দরটিতে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু করা হলে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে শিক্ষা, চিকিৎসা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের যেমন প্রসার ঘটবে, তেমনি ভ্রমণপিপাসুরা সহজে আসা-যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
জানা যায়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে ভারতের শিলিগুড়ির দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার, জলপাইগুড়ি ৪০ কিলোমিটার, দার্জিলিং ৬০ কিলোমিটার, নেপালের কাকরভিটা ৫৯ কিলোমিটার, ভুটানের ফুয়েন্ট সিলিং ১২০ কিলোমিটার এবং চীনের নাথুলা সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার। ফলে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন সুবিধা চালু হলে এই স্থলবন্দরে বেনাপোলের  চেয়ে কয়েকগুণ  বেশি রাজস্ব আদায় হবে। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে যাতায়াত করবে। বন্দর সূত্র জানায়, ’৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে বাণিজ্য কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয়। সে সময় ভারতের সঙ্গে এ বন্দর দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম না থাকায় ভারতের অভ্যন্তরের ৩৬ কিলোমিটার সড়ক ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে স্বল্প পরিসরে বাণিজ্য কার্যক্রম চলে। ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য কার্যক্রম উদ্বোধনের পর বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর চতুর্দেশীয় বন্দরে রূপান্তরিত হয়।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭৬ লাখ ৩ হাজার ৩০৪ টাকা। এর আগে ২০১১-২০১২ অর্থবছরে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে এক  কোটি ৮২ লাখ ৩৬ হাজার ১৮০ ইউএস ডলারের পণ্য ভারত ও নেপালে রপ্তানি করে ১১ কোটি ১৮ লাখ ৭২ হাজার ৭৬৪ টাকা রাজস্ব (আমদানি শুল্ক) আদায় হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৯৪ লাখ ১৬ হাজার ২৯০ ইউএস ডলার পণ্য রপ্তানি করে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৩ কোটি ৮২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ২৩ কোটি ৩৫ লাখ ৫৬১ টাকা। বন্দরটিতে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু হলে জাতীয় রাজস্ব আয় বহুগুণ বেড়ে যাবে। কর্মসংস্থান হবে জেলার অনেক বেকার মানুষের।
এ প্রসঙ্গে আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন পঞ্চগড়ের সভাপতি মেহেদী হাসান খান বাবলা বলেন, বন্দরটিতে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু হলে দ্রুত সাধারণ মানুষ চিকিৎসা, শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর হবে এশিয়ার বড় বন্দর। এদিকে আমদানি-রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা স্থলবন্দরের নানা অনিয়মের কথাও বলছেন। একাধিক ব্যবসায়ী জানান, একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট রাজস্ব ফাঁকিসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত। আমদানি বা রপ্তানি করতে গেলেই ট্রাকপ্রতি কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে মোটা অংকের ঘুষ দিতে হয়। না দিলে পণ্যবাহী গাড়ি দিনের পর দিন আটকে থাকে। গত ১৯ মে এ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা ২ হাজার ৪০০টি বাইসাইকেল শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা আটক করে। এর মধ্যে ৪৮০টি বাইসাইকেলের রাজস্ব পরিশোধের কাগজপত্র ও বন্দর কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র ছিল। এ সময় পাঁচটি ট্রাকের আটজন চালক ও সহকারীকে আটক করা হয়।

বন্দর-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশাসনের নজরদারির অভাবে ফলমূল, সাইকেলসহ আমদানি করা নানা পণ্যে ওজন কম দেখিয়ে সরকারি রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ করে দেওয়া হয়। অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এ সুযোগ দেওয়ায় সংশ্লিষ্টরা ইতিমধ্যে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। ওই মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি সিন্ডিকেট পরিচালক সিএন্ডএফ এজেন্ট বিনয় কুমার, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নীলফামারীর সৈয়দপুরের রাজু সাইকেল স্টোর ও বাংলাবান্ধার এবি ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী এবং বন্দরের কাস্টমস সুপার ও ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি।
সিএন্ডএফ এজেন্ট নসিমুল হাসান ও সাইদুর রহমান জানান, ‘স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়ন করা। অবকাঠামোর অভাবে অনেক ব্যবসায়ী মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।’

সর্বশেষ খবর