বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

১২ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জোট

হুমকিতে পোশাক খাত, সতর্ক পর্যবেক্ষণে সরকার

প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী ১২টি দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক জোট করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ধরনের জোট গঠনের বিষয়টি সতর্ক পর্যবেক্ষণে রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। কারণ এর সঙ্গে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের স্বার্থ জড়িত রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠি পাওয়ার পর জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আজ এ বৈঠকটি হওয়ার কথা রয়েছে।

বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জোট গঠনের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তারপরও আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি।

এদিকে এ ধরনের জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দাবি, বৃহত্তম এই অর্থনৈতিক জোটে বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামকে একই হারে শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক রপ্তানি করতে হয়। কিন্তু জোট গঠন হলে বিনা শুল্কে রপ্তানি সুবিধা পাবে ভিয়েতনাম। ফলে দেশের পোশাক খাত হুমকির মুখে পড়বে। উদ্বেগের আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) পর দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর একক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় আসে এই দেশটি থেকে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফলে রপ্তানি আয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই বাজার ভিয়েতনামের দখলে চলে যাওয়ার বিষয়টি দেশের পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাণিজ্য সচিবকে পররাষ্ট্রের চিঠি : চিঠিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, 'প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী ১২টি দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকাে, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনাম) সমন্বয়ে আন্তঃপ্রশান্ত অংশীদারিত্ব বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) নামে আন্তঃআঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা চলমান রয়েছে। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে উল্লেখিত দেশগুলো নিয়ে সৃষ্ট মুক্তবাজারের আকার হবে ৩০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ। সম্প্রতি ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ওই জোটে অন্তর্ভুক্তির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এতে আরও বলা হয়, 'বৃহৎ মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মার্কিন এ প্রচেষ্টায় এশিয়ার দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি ভারত ও চীন (যারা মার্কিন অর্থনীতির প্রতিদ্বন্দ্বী) না থাকার বিষয়টি বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হচ্ছে। এ উদ্যোগকে এশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মার্কিন প্রভাব বিস্তারের একটি নতুনতর প্রচেষ্টা হিসেবেও অনেকে বিবেচনা করছে।'

টিপিপি-তে ভিয়েতনামের অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের জন্য একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, 'যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। ইতিমধ্যেই দেশটি মার্কিন বাজারে দ্বিতীয় প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম উভয়েই ১৬ শতাংশ হারে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক দিয়ে থাকে। কিন্তু টিপিপি বাস্তবায়িত হলে ভিয়েতনাম শুল্ক ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির সুবিধা পাবে, যা বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হবে। জানা গেছে, এই চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে যে কয়টি পথ রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশেরও যুক্তরাষ্ট্রের ওই জোটে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করা অথবা দেশটিতে জিএসপি সুবিধায় পোশাক খাত অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দাবি করা। প্রথমটির ক্ষেত্রে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেতিবাচক মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। সূত্র জানায়, গত এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারিত্ব সংলাপেও যুক্তরাষ্ট্রের এই জোট গঠনের ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্বেগ তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে ওই জোটে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়। জবাবে মার্কিন প্রতিনিধি দলের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) মিজ ওয়েন্ডি শ্যারম্যান পররাষ্ট্র সচিবকে জানান, 'মুক্ত বাণিজ্য বিষয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সীমিত। তা ছাড়া টিপিপি-তে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে উচ্চমানের শ্রম ব্যবস্থাপনা, শ্রম অধিকার ও পরিবেশের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে।' এ অবস্থায় সম্ভাব্য করণীয় হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের ওপর জোর দিয়ে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বাণিজ্য সচিবকে চিঠিতে বলেন, ওয়াশিংটন দূতাবাসের তথ্যমতে বর্তমান সমঝোতা প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে টিপিপি-তে নতুন কোনো দেশের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা প্রায় ক্ষীণ। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের লক্ষ্যে বাংলাদেশের শ্রমমান ও পরিবেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার মনে হয় না, ভিয়েতনাম টিপিপি-তে বিশেষ কোনো সুবিধা পাবে। কারণ ওই জোটে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে যে ধরনের শ্রম কমপ্লায়েন্সের শর্ত রয়েছে সেটি ভিয়েতনামের নেই। তাদের চেয়ে বরং বাংলাদেশের শ্রমের মান অনেক বেশি ভালো।

বিশেষ করে রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর শর্তের কারণে আমরা শ্রম আইন পরিবর্তন ছাড়াও শ্রম পরিবেশ উন্নয়নে অনেক কাজ করছি। তবে তারপরও সরকার টিপিপির ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে জানিয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, বিকল্প হিসেবে আমরা এরই মধ্যে ওয়াশিংটন দূতাবাসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের আবেদন জানিয়েছি।

 

সর্বশেষ খবর