বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা
নির্যাতনে গত পাঁচ বছরে ২১৬ গৃহকর্মীর মৃত্যু

আদুরি-হ্যাপিদের রক্ষায় কেউ নেই

জিন্নাতুন নূর

আদুরি-হ্যাপিদের রক্ষায় কেউ নেই

অর্থাভাবে মা-বাবা শিশুর মুখে খাবার তুলে দিতে পারেন না। গরিব এ অভাগা শিশুদের অভিভাবকরা ভাবেন, ছোট মেয়েটিকে শহরে বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে পাঠালে একদিকে যেমন মেয়েটি উপোস করে মরবে না, অন্যদিকে কাজের বিনিময়ে পরিবারের জন্য কিছু টাকাও কামাই করবে। আর এমন চিন্তা থেকে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের কন্যাশিশুকে ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাজে লাগিয়ে দেন। ফলে যে বয়সে পুতুল খেলার কথা সে বয়সে ভারী কাজের দায়িত্ব তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর কোনো কারণে কাজে ভুল হলে কিংবা মনিবের মনমতো কিছু না হলেই নেমে আসে অমানুষিক নির‌্যাতন। কখনোবা দিতে হয় প্রাণ। মিরপুর পল্লবী আবাসিক এলাকায় একটি বাসায় মনি (ছদ্মনাম) নামের চার বছর বয়সের এক শিশুকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন এক দম্পতি। ঠিকমতো কথা বলতে না পারলেও কীভাবে ঘর ঝাড়– দিতে ও মুছতে হয়, থালাবাসন মাজতে হয় তা মনিকে শেখানো হচ্ছে। অবুঝ মনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কখনো কান্নাকাটি করে। তখন সেই বয়স্ক দম্পতির মেয়েটি মনিকে চড়-থাপ্পড় মারেন। জোর করে তার মুখে কাপড় চেপে দেন। ছোট্ট মনির কষ্টগুলো চাপা পড়ে যায়।

মনির মতো রাজধানীতে অনেক মেয়ে শিশু আছে যারা ক্ষুধা মেটাতে গৃহকর্মীর কাজ করে। অথচ এ শ্রমে শিশুদের নিয়োগ দেওয়া বেআইনি। কিন্তু সস্তা শ্রমের আশায় মানুষ এ শিশুদের ভারী ও বিপজ্জনক কাজ করাচ্ছেন। কাজে সামান্য ভুল হলে চুল টানা, চড়-থাপ্পড় দেওয়া, গরম খুন্তি দিয়ে ছেঁকা দেওয়া, লাঠি দিয়ে পেটানো, গরম পানি ও তেল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়াসহ অমানুষিকভাবে নির‌্যাতন করা হয়। এদের অনেককেই বাসার কর্তা কিংবা কর্ত্রী পর‌্যাপ্ত খাবার দেন না, এক বেলার খাবার দেন তো আরেক বেলা উপোস রাখেন। অনেককে রান্নাঘরে গরমের মধ্যে ঘুমাতে বাধ্য করা হয়। ২০১৩ সালে পল্লবীতে আদুরি নামের এক মেয়ে গৃহশ্রমিককে আবর্জনা থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায়, আদুরির গৃহকর্ত্রী ঠিকমতো খেতে দিতেন না। এতে আদুরি হাড্ডিসর্বস্ব হয়ে যায়। আদুরির শরীরের বিভিন্ন স্থানে আগুনের ছেঁকার দাগ পাওয়া যায়। মাথা, ঠোঁট ও মুখেও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। আদুরির মতো অমানবিকতার শিকার হয় আরেক শিশু মাহফুজা আক্তার হ্যাপি। ১১ বছরের এ শিশুটি জাতীয় দলের ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেনের বাসায় কাজ করত। কিন্তু কাজে ভুল হলেই হ্যাপির ওপর শাহাদাত ও তার স্ত্রী নির‌্যাতন চালাত। এতে মনে হচ্ছে আদুরি ও হ্যাপিদের রক্ষায় কেউ নেই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ২১৬ জন গৃহকর্মীর নির‌্যাতনের পর মৃত্যু হয়। এ সময় শত শত গৃহকর্মী আহত হন। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শিশু গৃহকর্মীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ শারীরিক নির‌্যাতনের শিকার হয়। বিলস বলেছে, ১০ বছরে গৃহকর্মী নির‌্যাতনের বিচার হওয়ার কোনো নজির নেই। তাদের রক্ষারও কেউ নেই। এদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপে ২০০৮ সালে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ আচরণ বিধিমালার খসড়া শ্রম মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করলেও এর অনুমোদন প্রক্রিয়া ঝুলে আছে। নিজেরা করির সমন্বয়কারী ও মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির বলেন, শিশু শ্রমিক থাকা বেআইনি। কিন্তু এরপরও বিপুলসংখ্যক শিশু শ্রমিকের কাজ করার বিষয়টি বলে দেয়, দরিদ্রতার কারণে শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য শিশু শ্রম নিরসনে সরকার কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে তার জবাবদিহিতা চাই।

 

সর্বশেষ খবর