শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

যোগাযোগ খাতে উন্নয়ন বিপ্লব

নিজস্ব প্রতিবেদক

যোগাযোগ খাতে উন্নয়ন বিপ্লব

গত সাত বছরে দেশের যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। প্রতিবন্ধকতাহীন ধারাবাহিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে গত মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর এবং বর্তমান সরকারের প্রায় দুই বছরে দেশের রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প থেকে শুরু করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া, বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করা, উত্তরা থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হাতে নেওয়া, ফেনীতে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প গ্রহণ, মেট্রোরেলের কাজ শুরু করাসহ অনেকগুলো উন্নয়ন কাজ এযাবৎকালে সরকারের বড় সাফল্য। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ, পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন সরকারের অন্যতম সাফল্য। দেশজুড়ে যোগাযোগ খাতের এমন উন্নয়নের সুফল ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে। এর মধ্যে তৎকালীন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প। মহাজোট সরকারের প্রথম দিকেই পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে হাত দেওয়া হয়। কিন্তু সব প্রস্তুতি যখন প্রায় সম্পন্ন তখনই বিশ্বব্যাংকের তরফে অভিযোগ ওঠে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের। প্রথম থেকেই সরকার এ অভিযোগ অস্বীকার করে এলেও শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। তারপর সরকার এককভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেয়। ধাপে ধাপে সরকার এ সেতু নির্মাণ প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে হাত দেয়। সর্বশেষ গত জানুয়ারি মাসে মূল সেতু নির্মাণের পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবে টেস্ট পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, পদ্মা সেতু ২০১৮ সালেই উদ্বোধন হবে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। যোগাযোগ খাতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এ দুই মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা। দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এ দুই মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ চললেও শেষ পর্যন্ত দুটো প্রকল্পেরই কাজ শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নিয়মিত মনিটরিংয়ের কারণে ইতিমধ্যে জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ শেষ পর্যায়ে। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মহাসড়কটির কাজও আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরে চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সেপ্টেম্বর মাসেই শুরু হয়েছে জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ। এডিবির অর্থায়নে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। এর পুরোটাই দেবে এডিবি। এ ছাড়া সারা দেশে আরও এক হাজার ৭৫২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে চার লেনে উন্নীত করা প্রতিটি সড়কেই থাকবে ধীর গতির যানবাহন চলাচলের জন্য পৃথক দুটি লেন। ইতিমধ্যে এসব সড়কের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি সড়কগুলোর কাজও সম্পন্ন করা হবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং অন্যান্য দাতা সংস্থা ও সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এই এক হাজার ৭৫২ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। সূত্র জানায়, আগামী কয়েক বছরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ২২৬ কিলোমিটার, সিলেট-তামাবিল স্থলবন্দর সড়ক, দৌলতদিয়া-মাগুরা-ঝিনাইদহ-যশোর-খুলনা-মংলা পর্যন্ত ২১২ কিলোমিটার মহাসড়ক, হাটিকুমরুল-রংপুর-বুড়িমারী স্থলবন্দর পর্যন্ত ১৫৭ কিলোমিটার মহাসড়ক এবং টেকেরহাট-কুয়াকাটা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। এ ছাড়া নোয়াখালীর সোনাপুর-সোনাগাজী-জোড়াগঞ্জ সড়ক আপগ্রেডেশনের কাজ সম্পন্ন করা হবে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে শুরু হবে হাটিকুমরুল-রংপুর-বুড়িমারী স্থলবন্দর পর্যন্ত ১৫৭ কিলোমিটার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ। এ প্রকল্পেও অর্থায়নের বিষয়ে এডিবির সঙ্গে সরকারের সমঝোতা চূড়ান্ত পর্যায়ে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ২২৬ কিলোমিটার রাস্তা চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হবে ২০১৮ সালে। সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট আবার সরকার গঠন করলে বিগত মহাজোট সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে এসব প্রকল্পসহ আরও বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে নির্মাণ করা হচ্ছে টানেল। এটি চট্টগ্রামের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই টানেল নির্মাণের বিষয়ে ইতিমধ্যে চীনের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে সরকারের। শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও গোমতী নদীর ওপর বিদ্যমান সেতুর পাশাপাশি আরও তিনটি নতুন সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।  দ্বিতীয় শীতলক্ষ্যা, দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু নামে এ তিনটি সেতু নামে প্রস্তাবিত সেতু তিনটির নকশা তৈরির কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। চারটি জাপানি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে সেতুগুলো নির্মাণ করবে। দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে এ সেতু তিনটি নির্মাণ করা হবে। বিদ্যমান পুরনো সেতুগুলো সংস্কারসহ এতে মোট ব্যয় হবে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। রাজধানীর বিমাবন্দর-সংলগ্ন কাউলিয়া এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন নানা জটিলতায় কাজ শুরু করা না গেলেও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই উড়াল সড়কটি ২০১৮ সালে উদ্বোধনের বিষয়ে তিনি আশাবাদী। ১৬ আগস্ট থেকে এ প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ শুরু হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে বর্তমান সরকার এতটাই অগ্রাধিকার দিয়েছে যে, রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত এবং নগরবাসীর চলাচল সহজ করতে নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রোরেল। ২০১৯ সালের মধ্যেই মেট্রোরেলের একাংশের কাজ শেষ করা এবং চালু করার লক্ষ্যে দ্রুত কাজ চলছে। নতুন এসটিপিতে মেট্রোরেল প্রকল্প আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে সারা দেশের যোগাযোগ খাতে কয়েক বছরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। বিশেষ করে বিভিন্ন জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ স্বাভাবিক ও গতিশীল করতে সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ১০টি সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে। একইভাবে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের যোগাযোগ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে সরকার। পর্যটনশিল্পের বিষয়টি মাথায় রেখে এ তিন জেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক উন্নয়ন করা হয়েছে। কক্সবাজারের সঙ্গে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন সড়ক। মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর এবং বর্তমান সরকারের প্রায় দুই বছরে সড়কপথের মতো রেলপথেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। রেলের উন্নয়নে বিগত মহাজোট সরকারের সময়ই পৃথক রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার রেল খাতকে এখনো অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে। ইতিমধ্যে নতুন নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ লাকসাম থেকে চিনকীর আস্তানা পর্যন্ত ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়েছে। টঙ্গী থেকে ভৈরব পর্যন্ত রেলপথকে ডাবল লাইনে উন্নয়ন করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ভৈরবে মেঘনা নদীর ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে দ্বিতীয় রেল সেতু। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। রেলের উন্নয়নে আরও বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার অংশ হিসেবে আগামী জানুয়ারি মাসেই পাল্টে যাবে রেলের চেহারা। রেলবহরে যুক্ত হবে নতুন ইঞ্জিন ও দুই শতাধিক নতুন কোচ।

 

সর্বশেষ খবর