শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চার গ্রামে কুটিরশিল্পের ৪০০ কারখানা

সাইফুল ইসলাম, যশোর

চার গ্রামে কুটিরশিল্পের ৪০০ কারখানা

যশোরের কেশবপুর উপজেলার আলতাপোল গ্রামের বাসিন্দা অজিয়ার রহমান। বছর দশেক আগে অন্যের জমিতে কামলা খাটতেন। এরপর শুরু করেন কাঠের ব্যবসা। পরে পাশের গ্রামের একজনের দেখাদেখি নিজের বাড়িতেই একটি কারখানা স্থাপন করেন। ওই কারখানায় মেহগনি কাঠ থেকে মোমদানি, ফুলদানি, কলমদানি, বাটি, পাউডার কেস, বয়াম, ডিম সেট, আপেল সেট, খুনতি, হামাম, পিঁড়ি, মেয়েদের চুড়ি রাখার আলনা, হারিকেন, পেনসিল, অ্যাশট্রে, সিঁদুর বক্স, ধামাপাতি, খয়েরদানি, টিফিন বক্সসহ নানা ধরনের শোপিস তৈরি করতে থাকেন। প্রথমে স্থানীয় বাজারে এগুলো বিক্রি শুরু করলেও পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার আসতে শুরু করে। ঘুরতেই থাকে ভাগ্যের চাকা। কারখানায় নিয়োগ দেন ছয়জন শ্রমিক। এখন কারখানাটিকে আরও বড় করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। স্থানীয়রা জানান, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে কেশবপুর উপজেলার আলতাপোল গ্রামের এক ব্যক্তি ভারত থেকে শিখে এসে কুটিরশিল্পের এ কাজ শুরু করেন। অল্প দিনেই সফলতার মুখ দেখেন তিনি। তার দেখাদেখি আলতাপোল, কন্দর্পপুর, বড়েঙ্গা ও মঙ্গলকোটসহ আশপাশের গ্রামগুলোর অনেকেই জড়িয়ে পড়েন এ শিল্পের সঙ্গে। দিন দিন এর ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে কেশবপুরের ওই চার গ্রামেই রয়েছে এ রকম অন্তত ৪০০ কারখানা। আর এসব কারখানায় মালিক-শ্রমিক ও কাঠ ব্যবসায়ী মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন। আলতাপোল গ্রামের একটি কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম জানান, মূলত মেহগনি কাঠ থেকে তারা এসব জিনিসপত্র তৈরি করেন। বেশ আগে থেকেই এ কাজ শুরু হলেও এর ব্যাপকতা লাভ করে এ অঞ্চলে বিদ্যুৎসংযোগ আসার পর। তার অধীনে আটজন শ্রমিক কাজ করছেন। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা লাভ থাকে তার। ভাই ভাই কুটির শিল্পের মালিক কবির হোসেনের কারখানায় কাজ করেন ৫৩ জন শ্রমিক। তিনি জানান, ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শ্রমিকরা কাজ করেন। অনেক শ্রমিক মাসিক বেতনে কাজ করলেও অনেকে কাজ হিসেবে টাকা নিয়ে থাকেন। তিনি জানান, প্রতি পিস ফুলদানি, বয়াম, পাউডার কেস, অ্যাশট্রে ৪ টাকা করে, কলস ও বাটি ২ টাকা করে, ডিম সেট, চুরির আলনা ৮ টাকা করে, খুনতি ৩ টাকা, বড় বয়াম ১৫ টাকা হিসেবে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। কারখানা শ্রমিক সফিউল জানান, প্রতিদিন তারা সব মিলিয়ে ৫০-৬০টি খেলনা বা তৈজসপত্র তৈরি করতে পারেন। প্রতি পিসের মজুরি হিসেবে ২ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত পান। গড়ে দিনে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় হয় তাদের। সফিউল জানান, এ কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চলছে তাদের। আরেক শ্রমিক সুজিত বিশ্বাস বলেন, চার গ্রামে এখন কেউ বেকার বসে থাকে না। সবাই কোনো না কোনোভাবে এ কুটিরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। দিন-রাত এসব কারখানায় কাজ হয়। অনেক মহিলা শ্রমিকও কাজ করছেন। কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শরীফ রায়হান কবীর জানান, কেশবপুরের গ্রামগুলোয় তৈরি এসব পণ্য সারা দেশে সমাদৃত হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের উন্নত প্রশিক্ষণ, ঋণদান কর্মসূচিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল গ্রামের এসব কুটিরশিল্প পরিদর্শন করেছে। তারা এসব পণ্যের মান আরও উন্নত ও উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাজারজাতকরণের ওপর গুরুত্ব দেন। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, এক যুগ আগেও এ গ্রামগুলোর অনেক মানুষ কাজের অভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খেত। এখন সেই মানুষগুলোই সারা দিন থাকেন কর্মমুখর। নিজেদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও লেগেছে উন্নতির ছোঁয়া। কুটিরশিল্প মালিকরা বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাদের তৈরি কাঠের পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। এতে এ শিল্প আরও ব্যাপকতা লাভ করবে।

সর্বশেষ খবর