বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা
তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিতে বোমা

হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ওরা ১৬ জন

আলী আজম

হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ওরা ১৬ জন

১১ বছর বয়সী বালিকা স্নেহা। পেটে স্পি­ন্টার ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। দুই পা আর হাত স্পি­ন্টারে ক্ষতবিক্ষত রিনাও রয়েছে একই ওয়ার্ডে। একই বেডে বসে আছে হাতে ব্যান্ডেজ ও গলায় স্পি­ন্টারে আহত তার ছয় বছরের শিশু হাসান। শুধু এ তিনজনই নয়, এদের মতোই ১৬ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

আহত স্নেহা বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিনজিরার চড়াইল চেয়ারম্যান গলির শাহিনের বাড়িতে থাকে। চড়াইল নুরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবার নাম রাশেদ এবং মায়ের নাম সুমি। তার একমাত্র ভাই সিহাব (৫)। তার বাবা রাশেদ আটার দোকানে কাজ করেন।

স্নেহা জানায়, ঘটনার দিন জিনজিরার বাসা থেকে রিকশাযোগে তারা হোসনি দালানে আসে। তার সঙ্গে বাবা-মা ছাড়াও ছিলেন নানী আয়েশা বেগম, মামা তানভীর, খালাতো ভাই রাজন ও দুই চাচা সানজু ও সাজু। তারা হোসনি দালানে গিয়ে মিছিলের লাইনে দাঁড়ায়। প্রথম বোমা মারার পর লাইট বাস্ট হয়েছে বলা হলে কেউ দৌড় দেয়নি। দ্বিতীয় বোমাটি বাস্ট হলে তার শরীরে স্পি­ন্টার বিদ্ধ হয়। দৌড়াতে গিয়ে বারবার পড়ে গিয়েছি। এরপর কিছু মনে নেই। পরে যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পায়।

বোমা বিস্ফোরণে স্নেহার চাচা সানজু মারা যায়। স্পি­ন্টারে আহত স্নেহার মা সুমি ও খালাতো ভাই রাজন চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন। আর নানী আয়েশা বেগম এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চাচা সানজুর কথা জানতে চাইলে স্নেহা বলে, ‘সানজু চাচ্চু আমাকে খুব আদর করত। চাচ্চু মইরে গেছে। আমারে কে ঘুরতে নিয়ে যাবে, কে আদর করবে?’ দুই পায়ে ও হাতে স্পি­ন্টার বিদ্ধ রিনা ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। পাশেই বসে আছে বাম হাত ব্যান্ডেজ ও গলায় স্পি­ন্টার বিদ্ধ ছোট ছেলে হাসান। রিনার স্বামীর নাম ইউনুস। ওই দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। থাকেন আজিমপুর নিউ পল্টনের ৭৭/বি নম্বর বাড়িতে। ইউনুস কমিউনিটি সেন্টারে কাজ করেন। হাসান আজিমপুর লেডিস ক্লাবে নার্সারি পড়ছে। রিনা ওই দিনের ঘটনা স্মরণ করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘আমি আর কোনো দিন হোসনি দালানে যাব না। আমি আমার একমাত্র ছেলেকে হারাতে চাই না।’

রিনা জানান, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টায় বাসা থেকে হাসানকে নিয়ে বের হই। রিকশাযোগে হোসনি দালানে যাই। রাত ১টার দিকে ছোটভাই সানোয়ার হোসেন সানু আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। রাত পৌনে ২টার দিকে তারা একটি শব্দ শুনতে পান। লাইন বাস্ট হয়েছে ভেবে কেউ দৌড় দেয়নি। দ্বিতীয় বোমা মারা হলে রিনা ও তার ভাই সানু ছিটকে পড়েন। রিনার ছেলে হাসানও আহত হয়। রিনা ছেলেকে দৌড় দিতে বলেন। কিন্তু ছোট্ট হাসান সামান্য দূরে গিয়ে পড়ে যায়। সানুর সারা শরীরে স্পি­ন্টার বিদ্ধ হয়েছে। সে ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পেটে স্পি­ন্টার নিয়ে ঢামেক হাসপাতালের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে কাতরাচ্ছে ১১ বছর বয়সী সোহান। বাবা দিনমজুর সেলিম, মা পারভিন ও একমাত্র বোন শিলাকে নিয়ে পুরান ঢাকার বেচারাম দেউরির ১৫/৫ নম্বর বাড়িতে থাকে। সোহান স্থানীয় মাহুতটুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। গতকাল দেখা গেছে, সোহানের এক হাতে স্যালাইন লাগানো। পেট ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। দুটি পাইপ লাগানো হয়েছে। যন্ত্রণায় তেমন কথা বলতে পারছে না। খুবই আস্তে আস্তে কথা বলার চেষ্টা করছে। সোহান জানায়, ‘আমার সামনে পরীক্ষা। কবে ছাড়া পাব।’ এ সময় পাশে থাকা বাবা-মা কেঁদে ফেলেন। বলেন, ‘সোহান বাঁচবে তো?’

১৬ মাস বয়সী কায়েস। মা হালিমার সঙ্গে খেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু স্পি­ন্টারে আহত মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কায়েস। মা-ছেলে দুজন ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মা-ছেলে। আর বাবা সাটার মিস্ত্রি মনির হোসেন ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে কাতরাচ্ছেন। তারা থাকেন বংশালের কসাইটুলির ৩১ নম্বর বাড়িতে। নানী নূরজাহান শিশু কায়েসকে ফিডারের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। কায়েসের দুই পা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। তার দুপায়ে ও ঘাড়ে স্পি­ন্টার বিদ্ধ হয়েছে। তার মা ও বাবার শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পি­ন্টার বিদ্ধ হয়েছে। এ ঘটনায় মনিরের বড় ভাই নূর হোসেন ও তার খালাতো ভাই কামালও আহত হয়েছে। তারা পাঁচজনই ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঘটনার দিনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে মনির হোসেন বলেন, কখনো ভাবতে পারিনি হোসনি দালানে বোমা বিস্ফোরণ হবে। তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন। ঢামেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক খাজা আবদুল গফুর জানান, হোসনি দালানের ঘটনায় এখনো ১৬ জন ভর্তি আছে। এদের মধ্যে লেসফিতা বিক্রেতা জামাল উদ্দিন (৫৫) নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) রয়েছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া আহত সোহান, রিনা ও রাকিবের অবস্থা গুরুতর।

হাসপাতালে ভর্তি সবাইকে সারিয়ে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। গত শুক্রবার রাতে পুরান ঢাকার হোসনি দালান এলাকায় বোমা হামলায় সাজ্জাদুল সানজু নামে এক কিশোর নিহতসহ শতাধিক আহত হন।

সর্বশেষ খবর