মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দালালদের হাতে জিম্মি চুয়াডাঙ্গার চিকিৎসা

জামান আখতার, চুয়াডাঙ্গা

দালালদের হাতে জিম্মি চুয়াডাঙ্গার চিকিৎসা

নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ, চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা, ওষুধ বিতরণে  অনিয়ম, জনবল সংকট, দালালদের দৌরাত্ম্য নিয়ে চলছে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। আর ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উৎপাত তো আছেই। বহির্বিভাগে রোগীদের লম্বা লাইন থাকলেও চিকিৎসক ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট প্র্যাকটিসে। সমস্যার কথা উঠলেই কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে পাশ কাটিয়ে যান। ফলে সব অনিয়মই দিন দিন নিয়মে পরিণত হচ্ছে এখানে। সর্বোপরি ৫০ শয্যার অসম্পূর্ণ জনবল দিয়েই চলছে ১০০ শয্যার হাসপাতালটি। তবে হাসপাতালটি আড়াই শ’ শয্যায় উন্নীত করার জন্য চলছে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। ১৯৭০ সালে স্থাপিত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে ২০০৩ সালে। এক যুগেও ১০০ শয্যার প্রয়োজনীয় জনবল পায়নি হাসপাতালটি। আগের ৫০ শয্যার জনবল কাঠামোতেও আছে ঘাটতি। ফলে মারাত্মক জনবল সংকট নিয়ে কোনোরকমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৫০ শয্যার জনবলের মধ্যেও অ্যানেসথেসিয়ার সিনিয়র কনসালটেন্ট, নাক-কান-গলার জুনিয়র কনসালটেন্ট, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন। এ ছাড়া চক্ষু বিষয়ের সিনিয়র কনসালটেন্টের পদে আছেন জুনিয়র কনসালটেন্ট, পেডিয়াট্রিকের সিনিয়র কনসালটেন্টের পদে আছেন শিশু বিষয়ের জুনিয়র কনসালটেন্ট, মেডিসিনের সিনিয়র কনসালটেন্টের পদে আছেন সিনিয়র কনসালটেন্ট কার্ডিওলজি ও অর্থোসার্জারি বিষয়ের সিনিয়র কনসালটেন্টের পদে আছেন সার্জারি বিষয়ের সিনিয়র কনসালটেন্ট। এ ছাড়া দীর্ঘদিনেও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জনবল কাঠামোতে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারের পদগুলো পাওয়া যায়নি। এসব পদেও দায়িত্ব পালন করতে হয় অন্য বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগ খোলা থাকার কথা থাকলেও বেশির ভাগ চিকিৎসক আসেন বেলা ১০টা থেকে ১১টার পরে। অন্যদিকে বেলা ১টার পর কোনো চিকিৎসককেই তাদের কক্ষে পাওয়া যায় না। আবার হাসপাতালের চেম্বারে এসেও কিছু চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও দালালদের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠেন। ফলে বিশেষ সুবিধা নিয়ে হাসপাতালের ওষুধ বাদ রেখে ব্যবস্থাপত্রে নির্ধারিত কোম্পানির ওষুধ লেখেন তারা। প্রায়ই দেরিতে আসা চিকিৎসকদের কক্ষের সামনে রোগীদের লম্বা লাইন পড়ে যায়। জানতে চাইলেই শোনা যায়, ‘ডাক্তার সাহেব অফিসিয়াল কাজে রয়েছেন, বা মিটিংয়ে আছেন।’ অথচ দেখা যায় তিনি বাইরের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখায় ব্যস্ত। অভিযোগ আছে, কমপক্ষে আটজন চিহ্নিত দালাল স্বেচ্ছাসেবকের কার্ড গলায় ঝুলিয়ে হাসপাতাল চত্বরে ঘোরাফেরা করেন। এরা কৌশলে রোগীদের বিভিন্ন ক্লিনিক ও প্যাথলজিতে নিয়ে যান। আর এ কাজে কয়েকজন চিকিৎসক তাদের সহযোগিতা করেন বলেও অভিযোগ আছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের কয়েকজন স্টাফ নার্স জানান, ১০০ শয্যার হাসপাতালে সব সময়ই তিন শতাধিক রোগী ভর্তি থাকেন। এ অবস্থায় ৫০ শয্যার জনবল অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত ২২ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স আর ১১ জন স্টাফ নার্সকে দায়িত্ব পালন করতে হিমশিম খেতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় বরাদ্দ ছাড়াই হাসপাতালের কেবিন ব্যবহার করতে দেখা যায় অনেককে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কেবিনগুলো ফ্রি ব্যবহার করেন তারা। কর্তৃপক্ষ নমনীয় হওয়ায় হামেশাই এ ধরনের সুযোগ নিতে দেখা যায় তাদের। অথচ সাধারণ রোগীরা ফি পরিশোধ করার শর্তেও কেবিন পান না। রোগীদের অভিযোগ, সঠিক তদারকির অভাবে হাসপাতালের যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে নোংরা আর ময়লা-আবর্জনা। তাই দুর্গন্ধের কারণে নাকে রুমাল দিয়ে কোনো কোনো ওয়ার্ডে রোগীর স্বজনদের ঢুকতে দেখা যায়। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে আধুনিক মানের এক্সরে ও ইসিজি বিভাগ থাকলেও দালালদের কারণে সাধারণ রোগীরা সেখানে পৌঁছার আগেই তাদের ব্যবস্থাপত্র চলে যায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে এক্সরে মেশিনের ফিল্ম ও ডেভেলপার শেষ হয়ে যাওয়ায় সদর হাসপাতালের এক্সরে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। টেন্ডার কার্যক্রম শেষ করে ফিল্ম ও ডেভেলপার পেতেও মাস দুয়েক সময় লাগতে পারে বলে জানান আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাসুদ রানা। এ ছাড়া রোগীর এক্সরে ও ইসিজি করা হলেও খাতা-কলমে সে সংখ্যা কম দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আছে। অভিযোগ আছে, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে সচল ইসিজি মেশিন থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সেটি ব্যবহার করা হয় না। বহিরাগত জনৈক ব্যক্তির ব্যবসায়িক ইসিজি মেশিনেই হাসপাতালের ভিতর রোগীদের ইসিজি করানো হয়। এতে রোগীদের গুনতে হয় বাড়তি টাকা। এসব অব্যবস্থাপনা ও সমস্যা মাথায় নিয়েই আড়াই শ’ শয্যায় উন্নীত হতে যাচ্ছে হাসপাতালটি। এ জন্য অবকাঠামো নির্মাণও চলছে।

 ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে গণপূর্ত বিভাগ আটতলা ভিতবিশিষ্ট ছয়তলা ভবন নির্মাণ করছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এ ভবনের নির্মাণকাজ ২০১৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। এ ছাড়া চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা ও জীবননগর উপজেলায় রয়েছে তিনটি ৩১ শয্যার স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। কর্তৃপক্ষের নজরের বাইরে থাকার সুযোগে এখানকার চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করেন নামকাওয়াস্তে। রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে পান অবজ্ঞা আর অবহেলা। এ রকমই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাসুদ রানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, জনবল সমস্যার কারণে রোগীর চাপ সামাল দিতে কিছুটা সমস্যা হয়ে যায়। দালালদের দৌরাত্ম্যরে বিষয়ে তিনি বলেন, এ সমস্যা আছে, তবে তা আগের চেয়ে কম। জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘১০০ শয্যার হাসপাতালে সব সময়ই আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকে। ফলে ৫০ শয্যার অসম্পূর্ণ জনবল নিয়ে জেলার ১৬ লাখ মানুষের সঠিক সেবা দিতে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে।’ হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সপ্তাহের রবি ও বুধবার বেলা ১টার পর চিকিৎসকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দিয়েছি। এর বাইরে কেউ যদি হাসপাতালে আসেন তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর