বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চাইলেও যুক্তরাষ্ট্রের জোটে ঢুকতে পারবে না বাংলাদেশ

সরকারকে থিঙ্ক ট্যাংকগুলোর তথ্য

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১১টি দেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) নামে যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে, এর ফলে বাংলাদেশ ০ দশমিক ৫ শতাংশ রপ্তানি হারাতে পারে, আর্থিক মূল্যে যার পরিমাণ প্রায় ৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ অবস্থায় টিপিপি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ওপর বাংলাদেশকে সার্বক্ষণিক নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলো। সংস্থাগুলো সরকারকে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যে বাণিজ্যিক জোট করেছে, তাতে বাংলাদেশ চাইলেও ঢুকতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সুশাসনের অভাব, শ্রমমানের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব এবং বাণিজ্যে সক্ষমতার অভাব।

থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো সরকারকে আরও বলেছে, টিপিপিতে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নানা ধরনের বাণিজ্যিক বাধাও রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা, মাথাপিছু নিন্ম আয়, রপ্তানিনির্ভর আমদানি, মুষ্টিমেয় পণ্য রপ্তানি, স্বল্প পরিমাণে মূল্য সংযোজন, নিন্মমানের পণ্য তৈরির মতো বিষয়গুলোও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য জোটে বাংলাদেশের যোগদানের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে এই সীমাবদ্ধতাগুলো উল্লেখ করে গবেষণা সংস্থাগুলো সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বলেছে, টিপিপি চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে বিশ্ব বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর যে বাণিজ্যিক বৃত্ত তৈরি হতে যাচ্ছে, এর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশকে এখন জিএসপি পুনরুদ্ধারের জন্য জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে; পাশাপাশি টিটিপিভুক্ত দেশগুলোতেও শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে’। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১১ দেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের সরকারি-বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর সঙ্গে একটি বৈঠক করে। ওই বৈঠকে থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো টিপিপি বিষয়ে সরকারকে তাদের মতামত ও পর্যবেক্ষণ জানিয়ে দেয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও বিভাগগুলো হচ্ছে- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকস স্টাডিজ (বিআইআইএসএস), বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই), এফবিসিসিআই, ট্যারিফ কমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৈঠকের কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়, টিপিপির সদস্য রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে সর্বাধিক তৈরি পোশাক আমদানি করে এবং দেশটির বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক। বাংলাদেশ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে টিপিপিভুক্ত ১২ দেশে ৮ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ ওভেন গার্মেন্টস এবং নিটওয়্যার পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে একই সুবিধা ভোগ করছে। তবে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে তিন গুণ বেশি নিটপণ্য রপ্তানি করে থাকে। টিপিপিতে ভিয়েতনাম থাকায় এ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ওই দেশটির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। টিপিপিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। টিপিপির অন্য দেশগুলো শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা না দেওয়ায় এ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ লাভবান হবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে এর প্রভাব পড়বে। এ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধি, দ্বিপক্ষীয় এফটিএ (মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) করা এবং রপ্তানি খাতে পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। কার্যপত্রে যাদের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সিপিডির প্রতিনিধি ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, তৈরি পোশাকের রপ্তানির ক্ষেত্রে টিপিপিভুক্ত দেশ থেকে পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহের শর্ত থাকলে বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, টিপিপি চুক্তির ব্যাপারে আরও বেশি তথ্যপ্রমাণভিত্তিক গবেষণা করা দরকার। টিপিপি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের এ ধরনের যেসব বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, সবগুলো মিলিয়ে একটি সমন্বিত গবেষণার পরামর্শ দেন তিনি। বিআইআইএসএসের চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, টিপিপির কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে টিকফার বৈঠকে তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরতে হবে। প্রয়োজনবোধে বিষয়টি নিয়ে নাইরোবিতে অনুষ্ঠেয় এলডিসি ফোরামের সভায় অন্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশকে টিপিপি জোটে যোগদানের আগে শ্রমমান, সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও বাণিজ্য সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। প্রসঙ্গত, গত মাসে জর্জিয়ার আটলান্টায় বিশ্বের ১২টি দেশ (যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম) নিজেদের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে তুলতে একটি চুক্তি সই করে, যার নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ‘প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী এই দেশগুলোর সমন্বয়ে আন্তপ্রশান্ত অংশীদারিত্ব বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) নামে আন্ত আঞ্চলিক এ চুক্তির ফলে সৃষ্ট মুক্ত বাজারের আকার হবে ৩০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ। ওই চুক্তির পর এক প্রতিক্রিয়ায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের টিপিপি চুক্তিতে আমরা ভীত নই। এর আগেও দেশের পোশাক খাতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর আমাদের শ্রমমান উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ ছিল, আমরা সেটি পূরণ করেছি। জিএসপি স্থগিতের পরও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে।’

সর্বশেষ খবর