মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ব্লগারদের নিরাপত্তায় সতর্কতা

অনেকে দেশ ছাড়ছেন কেউ কেউ নিয়েছেন সরকারি গানম্যান

জিন্নাতুন নূর ও আলী আজম

ব্লগারদের নিরাপত্তায় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। তাদের চলাফেরার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ব্লগাররা চলাফেরায় কাউকে সন্দেহ করলে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সর্বোপরি ব্লগারদের নিরাপত্তায় কোনো ঘাটতি নেই। গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ও পরিচিত এবং উগ্রবাদীদের হত্যার তালিকায় থাকা কয়েকজন ব্লগারকে গানম্যান ও পুলিশ প্রকেটশন দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি গণজাগরণ মঞ্চ-সংশ্লিষ্ট শীর্ষ ব্লগারদের গানম্যান ও পুলিশি বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাদের কেউ পুলিশের সাহায্য নিয়েছেন আবার কেউ তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এরই মধ্যে  ব্লগারদের নিরাপত্তায় দেশের ৬৪ জেলার এসপিসহ পুলিশের সব ইউনিটে ছয় দফা নির্দেশনা জারি করেছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। তবে শুধু ব্লগারদের নিরাপত্তা নয়, ব্লগিংয়ের মাধ্যমে যারা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাদেরও নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে।

এরই মধ্যে প্রাণভয়ে অনেক ব্লগার দেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এ তালিকায় অনেকেই আছেন। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যারা বিদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন তাদের সবাই প্রকৃত ব্লগার নন। এদের মধ্যে একশ্রেণির সুবিধাভোগী আছেন, যারা ধর্মীয় উসকানি দিয়ে জনপ্রিয় হতে চাইছেন। তারা ব্লগিংয়ের অপব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) মো. আছাদুজ্জামান মিয়া  বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্লগারদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। তাদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যারাই নিরাপত্তা চেয়েছেন তাদের তা দেওয়া হয়েছে। ব্লগারদের চলাফেরার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ সাধ্যমতো তাদের নিরাপত্তা জোরদার করেছে। গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী ও ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু বেশ কয়েকবার হত্যার হুমকি পেয়েছেন। এ জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। বর্তমানে তার এলাকা লালবাগ জোনের পুলিশ তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। ১ নভেম্বর বাপ্পাদিত্য তার মুঠোফোনে ‘বি প্রিপেয়ার্ড নেক্সট টার্গেট ইউ’ এমন একটি খুদেবার্তা (এসএমএস) পান। তিনি জানান, এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি জিডি করেছেন তিনি। তাই এ হুমকির পর আর নতুন করে জিডি করেননি। বাপ্পাদিত্য বলেন, এভাবে পুলিশ প্রহরা কারও জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। তবে অন্তত সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার প্রশ্নে পুলিশ প্রহরা জরুরি। এ ছাড়া আরেক ব্লগার অমি রহমান পিয়ালের নিরাপত্তার জন্যও পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান জানান, বাপ্পাদিত্য বসুর বাসার আশপাশে এখন পেট্রোল পুলিশ থাকছে। তাকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া তার বাসা থেকে বের হওয়ার পর এবং বাসায় প্রবেশের আগ পর্যন্ত তাকে পুলিশ প্রটেকশন দেওয়া হচ্ছে। তবে এর আগে ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয় নিজেই হত্যার হুমকি পেয়ে খিলগাঁও থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। এর কিছুদিন পর নিলয় খুন হন। সে সময় পুলিশ প্রশাসন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। এ বিষয়ে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্লগারদের প্রকাশ্যে ও গোপনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। অনেকে পুলিশি সহযোগিতা নিতে চান না। বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্লগারদের কম-বেশি নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ব্লগারদের নিরাপত্তায় ৬৪ জেলার এসপিসহ পুলিশের সব ইউনিটে ছয় দফা নির্দেশনা জারি করেছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। এর অংশ হিসেবে সব ইউনিটে স্পেশাল টাস্কগ্রুপ গঠন করতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি এ নির্দেশনা জারি করা হয়। স্পেশাল টাস্কগ্রুপকে লেখালেখির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রদানকারীদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্লগারদের লেখা বিশ্লেষণ করে তাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ধর্মীয় উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনাও আছে। গণজাগরণ মঞ্চের কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে গিয়ে কিছু উসকানিদাতা, যারা নিজেদের ব্লগার দাবি করেন, তারা সাধারণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করছেন। তারা না বুঝেই শুধু জনপ্রিয় হতে উসকানি ছড়াচ্ছেন। এদের মধ্যে একটি শ্রেণি আছে, যারা দেশের বাইরে পাড়ি জমানোর জন্য এমন করছেন। তবে এ বিষয়ে রাষ্ট্র ও ব্লগার কমিউনিটিকে সচেতন হতে হবে।

সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের এক অনুষ্ঠানে মুক্তমনা ব্লগারদের উদ্দেশ করে পুলিশপ্রধান (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেন না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা একটি অপরাধ। এটি পেনাল কোড ও আইসিটি অ্যাক্টে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদি কেউ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেন, তাহলে তার ১৪ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।’ গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক কামাল পাশা চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুলিশ ব্লগারদের নিরাপত্তা দিতে চায়। পুলিশ বিভাগ থেকে আমাকে অনেকবার গানম্যান নিতে বলা হয়েছে। তবে আমি নিইনি। কিন্তু তারা চিহ্নিত ব্লগারদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছেন। সরকারি এজেন্সি থেকে তাদের চলাচলের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তবে এটিও বুঝতে হবে যে, সব ব্লগারকে গানম্যান দেওয়া সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘অনেকেই আছেন, যারা ধর্মীয় উসকানিমূলক কথা লিখে নিজেকে সামনে আনতে চাইছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিদেশে যাওয়ার জন্য একে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। তবে আমাদের বুঝতে হবে, মুক্তবুদ্ধি মানেই কারও মনে আঘাত দেওয়া নয়। সমাজের একটি শ্রেণি এই উসকানিমূলক কথা লিখে সুবিধা নিচ্ছে।’

সম্প্রতি গণজাগরণ মঞ্চ-সংশ্লিষ্ট শীর্ষ ব্লগারদের গানম্যান ও পুলিশি বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগেও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ও অমি রহমান পিয়ালসহ কয়েকজনকে গানম্যান দেওয়া হয়। পুলিশের রমনা জোনের এসি শিবলী নোমান বলেন, গণজাগরণ মঞ্চ ও ব্লগারদের অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। যতটুকু নিরাপত্তা প্রয়োজন তা দেওয়া হচ্ছে। তাদের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া কেউ ব্যক্তিগত চলাফেরায় পুলিশি সহযোগিতা চাইলে তাকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। দেশের বেশ কয়েকজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় এক বছর ধরেই একের পর এক হুমকি ও পুলিশের কাছে প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাওয়ায় তারা বিদেশ যাওয়ার দিকে ঝুঁকেছেন। নিরাপত্তার জন্য ব্লগারদের কেউ বিদেশে স্বল্পকালীন, আবার কেউ দীর্ঘমেয়াদি আশ্রয়ের আবেদনও করেছেন। মূলত একের পর এক ব্লগার-হত্যায় আতঙ্কিত হয়েই তারা এ আবেদন করেছেন। জানা যায়, দেশত্যাগের তালিকায় আছেন ১০ জনেরও বেশি ব্লগার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্লগাররা জার্মানি, ফ্রান্স, নরওয়ে, লন্ডন ও সুইডেনে বেশি আশ্রয় নিচ্ছেন। তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের মাধ্যমে বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছেন। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যার পর দুই দফায় আক্রমণের শিকার হন আলোচিত-সমালোচিত ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। গত বছরের শেষার্ধে তিনি স্থায়ীভাবে জার্মানি চলে যান। এরপর চলতি বছরের জুলাইয়ে জার্মানি যান হুমায়ুন আজাদের ছেলে ব্লগার অনন্য আজাদ। একই মাসে দেশ ছেড়ে নরওয়ে গিয়েছেন ব্লগার সন্ন্যাসী রতন। তার আগে মে মাসে দেশ ছাড়েন ব্লগার ও লেখক সৈকত চৌধুরী। কাছাকাছি সময়ে দেশ ছেড়ে সুইডেন গিয়েছেন ব্লগিংয়ের জন্য পুলিশি হয়রানির শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ব্লগার সুব্রত শুভ এবং ক্যামেলিয়া কামাল। সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সে গিয়েছেন আরেক ব্লগার মনির। অক্টোবরের মাঝামাঝি জার্মানি গিয়েছেন ব্লগার তন্ময় চক্রবর্তী। সর্বশেষ অক্টোবরের শেষে ঢাকা ছাড়েন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শাম্মী হক। শাম্মী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, ‘সর্বশেষ দুই মাস পুলিশি নিরাপত্তায় ছিলাম। কিন্তু পুলিশি নিরাপত্তা নিয়ে স্বাভাবিক জীবন সম্ভব নয়। ছাড়তে হয়েছে পড়াশোনা, চাকরি, এমনকি থাকার হোস্টেলও। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছি দেশ ছাড়তে। জানি না আর কবে দেশে ফিরতে পারব।’ এদের বাইরে আরও যেসব ব্লগার দেশ ছেড়ে জার্মানি গিয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন দাউদ হায়দার, ওমর ফারুক লুকস, ফারজানা কবির খান ও ছদ্মনামধারী ‘নাস্তিকের ধর্মকথা’। লন্ডনে গিয়েছেন কামরুল হাসান, সুশান্ত দাশগুপ্ত, আরিফুর রহমান, অজন্তা দেব রায়, শান্তনু আদিব, নিঝুম মজুমদার ও রুমানা হাশেম। এ ছাড়া রায়হান আবির কানাডায় এবং নির্ঝর মজুমদার আছেন সুইডেনে। হুমায়ূন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদ ব্লগারদের হিটলিস্টের পরবর্তী টার্গেট ছিলেন। তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জার্মানিতে একটি স্কলারশিপ পাওয়ার কথা জানান। সেখানে যাওয়ার পর তিনি ফেসবুকে ছবিও আপলোড করেছেন। তিনি জানান, দেশে নিরাপদ বোধ না করায় জীবন বাঁচাতে জার্মানিতে গিয়েছেন। কবে ফিরবেন তা জানেন না। তবে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, অনন্য পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চাননি। কোনো থানায় নিরাপত্তা চেয়ে জিডিও করেননি তিনি।

ব্লগাররা জানান, নিরাপত্তা দেওয়ার চেয়ে পুলিশ তাদের তাড়াতাড়ি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বলেন। পুলিশের ওপর তাদের আস্থা নেই। তারা পুলিশের কাছে যান না। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ব্লগারদের ওপর নজরদারিসহ তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। কাউকে কোনো হুমকি দেওয়া হলে তা তদন্ত করা হচ্ছে। ব্লগাররা চলাফেরায় কাউকে সন্দেহ করলে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সর্বোপরি ব্লগারদের নিরাপত্তায় কোনো ঘাটতি নেই। এ ছাড়া কোনো ব্লগার অনুভূতিতে আঘাত আসে এমন লেখালেখিতে জড়িত কি না তা মনিটর করা হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর