রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দালাল চক্রে জিম্মি চমেক হাসপাতালের রোগীরা

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

দালাল চক্রে জিম্মি চমেক হাসপাতালের রোগীরা

‘আপনি ওনার সঙ্গে যান। সেখানে এক জায়গায় একসঙ্গে কম খরচে সব পরীক্ষা করাতে পারবেন।’ এভাবেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে রোগীদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের হাতে তুলে দেন কর্মরত ওয়ার্ডবয়রা। রোগীরাও কিছু বুঝে ওঠার আগেই এবং কম টাকার আশায় দালালের সঙ্গে যান। ব্যয় হয় অতিরিক্ত টাকা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালের গরিব ও অসহায় রোগীরা সংঘবদ্ধ একটি দালাল চক্রের কাছে দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি। জরুরি বিভাগ, ব্লাডব্যাংক, বহির্বিভাগ ও ওয়ার্ড ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি চক্র। ওষুধ কেনা, রোগ নির্ণয়, এমনকি প্রসূতি ওয়ার্ডের শিশুদের নানা সামগ্রী কেনার সময়ও দালালদের খপ্পরে পড়তে হয় সাধারণ রোগীদের। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত থাকে ওয়ার্ডবয়, আয়া, নার্স ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার। টাকা দিতে হয় ট্রলি ও হুইল চেয়ার ব্যবহারে। জানা যায়, হাসপাতালকে কেন্দ্র করে চারপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতাল। বিনা ও স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা নিতে চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে গরিব, অসহায় ও হতদরিদ্র রোগীরা আসেন সরকারি এ সেবাকেন্দ্রে। কিন্তু হাসপাতালের ভিতর ওয়ার্ডবয়, আয়া ও দালালদের খপ্পরে পড়তে হয় রোগীদের। বিভিন্ন পরীক্ষা বাবদ দালালদের মাধ্যমে ডায়াগনস্টিক ল্যাবগুলো রোগীদের কাছ থেকে প্রতিদিন নানাভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। হাসপাতাল ঘিরে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর আছে ৩০ থেকে ৪০ জন সক্রিয়া দালাল। এর মধ্যে আছে পাঁচ থেকে সাতজন মহিলা। গত বছর ৮ ডিসেম্বর হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের বহির্বিভাগ থেকে রাজিয়া বেগম (৫০), শোভা দে (৫০), মিতু রানী (৫০), জাহানারা বেগম (৪০) ও প্রমিতা দাশ (৪০) নামের পাঁচ নারী দালালকে আটক করে পুলিশ। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রোগীদের সেবায় হাসপাতালের ভিতরই আছে পরমাণু কেন্দ্র, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, রেডিওলোজিসহ কয়েকটি বিভাগ। এসব বিভাগে কম টাকায় বিভিন্ন ধরনের এক্স-রে, ইসিজি, এন্ডোসকপি, ব্লাড টেস্ট, এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ নানা পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু হাসপাতালে এসব পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকার কথা ওয়ার্ড-সংশ্লিষ্টরা রোগীদের বলেন না। যারা পরীক্ষার কথা জানেন তাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে হাসপাতালের দায়িত্বরতরা দালালদের হাতে তুলে দেন। আবুল কালাম নামের এক রোগী বলেন, ‘চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ওয়ার্ডবয় ল্যাবের একজন দালালের সঙ্গে আমাকে যেতে বলে। গিয়ে দেখি মাত্র তিনটি পরীক্ষার বিল এসেছে ৪ হাজার টাকা। অথচ আমার এক পরিচিত ডাক্তার বলেছেন, পরীক্ষাগুলো এক থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে হাসপাতালেই করা সম্ভব।’

অভিযোগ আছে, হাসপাতালের নার্স, আয়া, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর যোগসাজশে দালাল চক্র নানা অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ চক্রের মাধ্যমে চলছে প্রতি টেস্টে অতিরিক্ত ২০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়া, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে ওয়ার্ড ও বহির্বিভাগের লোকদের নেপথ্য যোগসাজশ, ল্যাব থেকে দালালদের মাসোহারা দেওয়া, রোগীদের ল্যাবের দালালদের হাতে তুলে দেওয়া।

চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. শেখ শাহাবুদ্দিন বলেন, হাসপাতালে দালাল চক্রের সমস্যা দীর্ঘদিনের। তবে এখন আগের চেয়ে অনেক কমেছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। এ ছাড়া দালাল চক্র ঠেকাতে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটিও গঠিত হয়েছে। তারা যে কোনো সময় দালাল দেখলেই ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। তিনি বলেন, ‘কোনো রোগী যদি হাতেনাতে কোনো দালালকে ধরেন আমরা এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’

জানা যায়, হাসপাতালের প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৬০ থেকে ১০০ জন রোগী চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ জন রোগীকে চিকিৎসক টেস্ট দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ৩৪টি অন্তর্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসকরা রোগী দেখে নানা ধরনের পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন। দালালরা এ সুযোগ ব্যবহার করে ‘কম টাকায় পরীক্ষাগুলো করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি’ দিয়ে নিজেদের ল্যাবে নিয়ে যান। অনেক সময় একজন রোগীকে তিন-চারটি ল্যাবের দালালরা ঘিরে ধরে। প্রত্যেকে নিজের ল্যাবে বিভিন্ন ছাড়ের লোভ দেখিয়ে রোগীদের আগ্রহী করে তুলে। রোগীরাও কম টাকার আশায় কোনো একজনের ফাঁদে পড়েন। পরে পরীক্ষা বাবদ কয়েক গুণ বেশি টাকা গুনতে হয় তাদের। উপ-পরিচালক ডা. শেখ শাহাবুদ্দিন বলেন, হাসপাতালে কী কী টেস্ট করা যায় তা ডাক্তার এবং কর্মরত সবাইকে বলা আছে, তারা যেন রোগীদের তা বলেন। এ ব্যাপারে রোগীদেরও সচেতন থাকা দরকার।

সর্বশেষ খবর