সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নতুন বেতন স্কেলে সাত অসঙ্গতি

নিজামুল হক বিপুল

অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তত সাতটি অসঙ্গতি রয়েছে। এসব অসঙ্গতি সংশোধন না করে নতুন বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশ করা হলে সরকার খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব অঙ্গতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ কার্যকরের তারিখের (১ জুলাই) আগে অবসরে যাওয়া এবং নানা জায়গায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে নিয়োজিত সচিব ও অতিরিক্ত সচিব এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা নতুন বেতন স্কেলে পূর্ণাঙ্গ যাবতীয় আর্থিক সুবিধা এবং নতুন নির্ধারিত মূল বেতনের ওপর পেনশন ও গ্রাচ্যুইটি পেতে সরকারকে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে। সব ধরনের নিয়মনীতি ও বিধি-বিধান ব্যতিরেকে তারা এ ব্যাপারে বিধান রাখার জন্য অর্থ বিভাগকে প্রস্তাব করেছে। যদিও ইতিপূর্বে কখনো জাতীয় বেতন স্কেলে এ রকম কোনো সুবিধা ছিল না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বেতন স্কেলে যদি এমন বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে সরকারকে ব্যাপক আর্থিক টানাপড়েনে পড়তে হবে। কারণ নতুন বেতন স্কেলে অবসরের পর কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা পাবেন। আর এই সুবিধাটিই নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বেতন স্কেল কার্যকর করার তারিখের আগে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারা। 

অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে অবসর গ্রহণকৃত (পিআরএল) এবং সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দফতরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সব সময় নতুন বেতন স্কেল অনুযায়ী শুধু বর্ধিত হারে চিকিৎসা ভাতা এবং বছরে দুটি উৎসব ভাতা দেওয়া হতো। কিন্তু এবার নতুন বেতন স্কেল চূড়ান্ত অনুমোদনের পর থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে নিয়োজিত কর্মকর্তারা এবং বেতন স্কেল কার্যকরের তারিখের আগে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারা নানাভাবে চাপ দিচ্ছেন পূর্ণাঙ্গ যাবতীয় আর্থিক সুবিধা নতুন স্কেলে পাওয়ার জন্য। জানা গেছে, কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার সুবিধার জন্য এই বিধান রাখতে সচিব কমিটি উঠেপড়ে লেগেছে। তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ রকম আর্থিক সুবিধাটি নতুনভাবে পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করা কোনোভাবেই সরকারের জন্য ইতিবাচক ও সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না। এই অসঙ্গতি ছাড়াও নতুন বেতন স্কেলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অসঙ্গতি হচ্ছে- অষ্টম ও নবম গ্রেড নিয়ে। পে-কমিশনের সুপারিশে না থাকা সত্ত্বেও সচিব কমিটির নির্দেশনায় প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে প্রথম শ্রেণির পদে যোগদানের সময় বিসিএস ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা হলে অষ্টম গ্রেড এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তা হলে নবম গ্রেডে যোগদান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো সার্ভিসের প্রথম শ্রেণির সূচনা পদে এই বিধান চরম বৈষম্যমূলক, অমর্যাদাকর এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে সঠিক মনোনিবেশের পরিপন্থী হবে। তাই সব প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার জন্য আগের মতো একই গ্রেডে বেতনের ব্যবস্থা রাখাটাই সমীচীন হবে। তা না হলে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, অধিদফতর, পরিদফতরে কর্মরত প্রায় ৩০ হাজার নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে প্রচণ্ড অসন্তোষ দেখা দেবে ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রে সার্বিকভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। শুধু তাই নয়, এ কারণে রাষ্ট্র বিশেষায়িত ও টেকনিক্যাল সার্ভিসসমূহ থেকে পাওয়া সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে জটিলতায় পড়তে পারে। সূত্র জানায়, নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির পদসমূহের মধ্যে রয়েছে- সহকারী জজ, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী প্রোগ্রামারসহ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সচিবালয়ের নন-ক্যাডারভুক্ত সহকারী সচিব, নির্বাচন কমিশনের সদর দফতর ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই), সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) বেসামরিক পদ ও সরকারের প্রায় সংস্থা, অধিদফতর, পরিদফতর ও করপোরেশন, কমিশনসমূহের প্রথম শ্রেণির সহকারী পরিচালক পদ, আবহাওয়া অধিদফতর, কারা মহাপরিদফতর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, কৃষি, পশু, মৎস্য ও গবেষণা সেক্টরের অসংখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরকারি খাতে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পরিদর্শক, রেজিস্ট্রার ইত্যাদি অসংখ্য প্রকারের পদাধিকারীরা। ইনক্রিমেন্ট নিয়েও আছে অসঙ্গতি। সূত্র জানায়, সরকারের আর্থিক বছরের বাজেট প্রণয়নে সঠিক হিসাবের সুবিধার্থে সব শ্রেণির কর্মচারীর জন্য একই তারিখে ইনক্রিমেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা করার জন্য ১ জুলাই/১৫ থেকে ৩০ জুন ১৬ পর্যন্ত সবার বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট আগামী এক বছরের জন্য বন্ধ রাখার প্রস্তাব করেছে অর্থ বিভাগ। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা হবে সম্পূর্ণ বেআইনি। কারণ এ জন্য এক বছর সবার ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রাখা যায় না। সংশ্লিষ্টরা আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন, ইনক্রিমেন্ট ভাতা নয়, বরং বেতনের অংশ। এটি সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আইনগত অবিচ্ছেদ্য অধিকার। চাকরি চলমান থাকলে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বৃদ্ধি চলমান থাকবে এটাই আইনানুগ। আইন অনুযায়ী কোনো রকম শাস্তি প্রদান ব্যতিরেকে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বৃদ্ধি কোনোভাবেই বন্ধ রাখা যাবে না। তাই নতুন জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ কার্যকরের তারিখ (১ জুলাই/১৫) থেকেই একটি ইনক্রিমেন্ট সবাইকে প্রদান করে মূল বেতন ফিক্সডআপ (নির্ধারণ) করলেই একই তারিখে ইনক্রিমেন্ট ব্যবস্থা প্রচলনের ক্ষেত্রে সরকারের ভালো উদ্দেশ্য সফল হবে। তা ছাড়া এক বছরের জন্য ইনক্রিমেন্ট বন্ধে মন্ত্রিসভার অনুমোদনও নেই। বিশেষায়িত বা টেকনিক্যাল সার্ভিসের অনুকূলে বিশেষ ভাতা প্রদানের বিষয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত রয়েছে। ‘টেকনিক্যাল ও বিশেষায়িত সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রচলিত, অর্থ বিভাগ কর্তৃক উত্থাপিত মূল বেতনের ৩০ ভাগ বিশেষ ভাতা অব্যাহত রাখার প্রয়োজন নেই মর্মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবকে অনাবশ্যক অভিহিত করেছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভা বলছে, এটির প্রয়োজন রয়েছে। অন্যান্য কতিপয় সার্ভিসের মতো রাষ্ট্রের বিশেষায়িত টেকনিক্যাল প্রকৃতির কাজের জন্য উল্লিখিত ভাতা অব্যাহত রাখা সমীচীন হবে।’ তবে তা ১ জুলাই ২০১৬ এর পূর্ব পর্যন্ত যেহেতু ভাতাসমূহ কার্যকর হবে না, তাই ইহা আগামী ১ বছরের জন্য বর্তমান প্রাপ্য অঙ্কে নির্দিষ্ট করা সমীচীন। কিন্তু অর্থ বিভাগ প্রস্তাব করেছে ১ জুলাই/১৬ এর পর ও সব সময়ের জন্য বিশেষ ভাতাসমূহ বর্তমান প্রাপ্য অঙ্কে (২০০৯ এর বেতন স্কেলের মূল বেতন অনুপাতে) সমগ্র চাকরিকালের জন্য নির্দিষ্ট করতে। অথচ জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ গেজেট আকারে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ এর বিধানসমূহ বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং বাতিলকৃত বেতন স্কেল ২০০৯ এর আনুপাতিক হারে বিশেষ ভাতা কীভাবে দেওয়া সম্ভব তা নিয়ে আইনগত প্রশ্ন রয়েছে। বরং নতুন জাতীয় বেতন স্কেলের মূল বেতনের আনুপাতিক হারে তা নির্ধারণ পূর্বক ১ জুলাই ২০১৬ থেকে তা কার্যকর করাই আইনগতভাবে সমীচীন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। প্রসঙ্গত, বর্তমান ও প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে যেসব সার্ভিসকে বিশেষ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই), ডিজিএফআই, এসএসএফ, পিজিআর, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, ভিডিপি, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও সেবিকারা। প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির ১০ বছর পূর্তিতে নানা কারণে যথাসময়ে পদোন্নতি দেওয়া না গেলেও তাদের উপ-সচিব বা পরিচালক বা সমমানের পদের বেতন স্কেল প্রদানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও তাদের ক্ষেত্রে কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এই বিষয়টিও পুনর্বিবেচনা করা সমীচীন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া বিদ্যমান ব্যবস্থায় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের প্রাপ্তি বহাল রাখা নিয়েও আছে অসঙ্গতি। সপ্তম জাতীয় বেতন স্কেলের বিদ্যমান ব্যবস্থায় টাইম স্কেল/সিলেকশন গ্রেড-এর বিধান অনুযায়ী ৩০ জুন, ২০১৫ তারিখের মধ্যে যারা এটি প্রাপ্য হয়েছিলেন তাদেরটি যে কোনো সময় গ্রহণ করা বৈধ হবে। কিন্তু ১ জুলাই, ২০১৫ তারিখ থেকে কার্যকর অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ এর ক্ষেত্রে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্ত করার ফলে ৩০ জুন ২০১৫ তারিখের পরে প্রাপ্য হওয়া কারও সিলেকশন গ্রেড গ্রহণ করে সেটি রেখে দেওয়া বা আইনগতভাবে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। অথচ প্রশাসন ক্যাডারের কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা বিশেষ ব্যাচের জন্য জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ এর গেজেটে এ রকম বিধান অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছেন। যা হবে বড় ধরনের আইনগত অসঙ্গতি। আর যদি রাখতেই হয় তাহলে তা ৩০ জুন ২০১৬ পর্যন্ত সব সার্ভিসের ও সব ব্যাচের জন্য রাখা সমীচীন হবে। 

এ ছাড়া বিশেষ বাহিনীর কর্মচারী সরকারি বাসায় বসবাস করেও মূল বেতনের ২০শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া বেতনের সঙ্গে পাওয়ার যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটিও বেআইনি, বৈষম্যমূলক এবং অযৌক্তিক বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। কারণ সরকারের বেসামরিক প্রশাসনের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী সরকারি বাসায় বসবাস করেও মূল বেতনের সঙ্গে নির্ধারিত বাড়িভাড়া ভাতা পান না। প্রচলিত মূল বেতনের আরও অতিরিক্ত ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ কর্তন করা হয়।

সর্বশেষ খবর