শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ

মেধা নয় কথা বলে টাকা

আকতারুজ্জামান

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেন মেধা নয় কথা বলে টাকা। রাজনৈতিক নেতা, পরিচালনা পর্ষদ ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন এসব নিয়োগে। চাকরিপ্রার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টরাই বলছেন এমন কথা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা ও উপজেলাভিত্তিক শিক্ষক পদে চাকরিপ্রার্থীদের মেধা তালিকা করে নিয়োগ দেওয়ার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এতে বন্ধ হতে পারে নিয়োগ বাণিজ্য। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগের জন্য গত ১১ অক্টোবর মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করেছে। এতে বলা হয়, নতুন পদ্ধতি বিষয়ে শিগগিরই একটি পরিপত্র জারি করা হবে। এ জন্য গত ২২ অক্টোবর থেকে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করে।

লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার সাপটিবাড়ী ডিগ্রি কলেজ। সম্প্রতি কয়েকটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে এতে প্রভাষক পদে আবেদন করেন ইমরান ফরহাদ সিদ্দিক। গত ৩০ অক্টোবর আবেদনকারীদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়, এতে প্রথম স্থান অধিকার করেন ইমরান। এই প্রার্থীর পিতামহ মরহুম আবুবকর সিদ্দিক ছিলেন কলেজটির আজীবন দাতা সদস্য। কিন্তু এ পদে তার চাকরি হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন এই কলেজের প্রভাষক রফিকুল আলম। ইনি আবার আদিতমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

চাকরির তদবির নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতেও ইমরানকে সতর্ক করেছেন রফিকুল আলম। সম্প্রতি রফিকুলের ফেসবুক টাইমলাইনে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত

একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাতে লেখা হয়েছিল, ‘কলেজে নিয়োগের জন্য সভাপতি এবং আমাকে যারা অর্থ প্রদান করেছেন তাদের আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নিয়োগপত্র দেওয়া হবে। এর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হবে না।’ এ স্ট্যাটাস নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। স্থানীয় কয়েকটি প্রিন্ট ও অনলাইনে এ খবরও ছাপা হয়েছে। কিন্তু চাকরিপ্রার্থী ইমরানকে একের পর এক হেনস্তা করছেন আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল। ইমরান ফরহাদ সিদ্দিকের এক বন্ধু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, ইমরান গত শুক্রবার রাতে সাপটিবাড়ী কলেজ মাঠে অবস্থান করলে উপ-পরিদর্শক শাহিন তাকে ধরে থানার ওসির কাছে নিয়ে যান। সেখানে গেলে রফিকুল আলমের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগ আনেন এবং তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দেওয়ার হুমকি দেন। রাতে থানায় আটকে রাখেন পরে সকালে থানায় গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল তাকে মারধর করে। পরে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেন ওসি আকতার হোসেন। আওয়ামী লীগ নেতা ও ওসির আতঙ্কে এখন দিন কাটছে ইমরানের। দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার একটি মাদ্রাসার শিক্ষক আশিকুর রহমান (ছদ্মনাম)। ২০০২ সালে একটি দাখিল মাদ্রাসায় তাকে নিয়োগ দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত শিক্ষকের বেতন এমপিওভুক্তি হয়নি। নিয়োগের সময় প্রায় ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও এখনো সে পদটি ফাঁকা রেখেছেন অধ্যক্ষ। এখন চেষ্টা করছেন এ পদে ৭ লাখ টাকায় আরেক প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে। বেতন এমপিও আদায়ে এ শিক্ষক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরাবর লিখিত অভিযোগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।  আশিকুর রহমান জানান, ২০০১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সাক্ষাৎকারে নির্বাচিত হয়ে পরের বছর ১৫ জানুয়ারিতে নিয়োগ পেয়ে মাদ্রাসাটিতে সহকারী মাওলানা পদে যোগদান করেন। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষাদান অব্যাহত রেখেছেন। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর ২০১০ সালে শিক্ষকদের বেতন এমপিও করার সময় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এ শিক্ষকের নামের স্থলে মোটা অঙ্কের টাকার মাধ্যমে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নিজের আরেক প্রার্থীর বেতন এমপিও করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিভিন্ন অযোগ্যতায় এ প্রার্থীর এমপিও আটকে দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। এখন মাদ্রাসাটিতে ওই পদে প্রায় ৭ লাখ টাকা চুক্তিতে আরেক প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন অধ্যক্ষ। শিক্ষক আশিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে অভিযোগ করে বলেন, যেহেতু আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আমার দাবি হচ্ছে আমাকেই যেন ওই পদেও এমপিও দেওয়া হয়। আশা করছি, এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। শুধু দিনাজপুরের বিরামপুরই নয় বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে সারা দেশেই মিলবে একই চিত্র। পরীক্ষায় ভালো করে নিয়োগ না পাওয়া, মেধাবীরা নিয়োগ পেয়েও বেতন এমপিও না হওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে শিক্ষা ভবন ও মন্ত্রণালয়ে ভুক্তভুগীরা ভিড় করছেন। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে গভর্নিং বডির সদস্যরা অযাচিত হস্তক্ষেপ করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে এমপিরাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি হচ্ছেন। অথবা এমপির আস্থাভাজন কাউকে প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য করছেন। সারা দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির বেশির ভাগ সভাপতি স্থানীয় সংসদ সদস্য বা তাদের ঘনিষ্ঠজনরা। তাদের ইচ্ছাতেই চলে প্রতিষ্ঠান। টাকার বিনিময়ে অদক্ষ ব্যক্তিদের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর