শিরোনাম
শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

যৌতুকের অভিশাপমুক্ত হতে পারছে না বাংলাদেশ

জিন্নাতুন নূর

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে আবার সেই বাংলাদেশের নারীরাই যৌতুকের অভিশাপে অকালে হারাচ্ছেন প্রাণ। যৌতুক নামক ‘সামাজিক ব্যাধি’র কারণে প্রতি বছর দেশে মৃত্যু হচ্ছে শত শত নারীর। এ কারণে নারীদের বীভৎস নির‌্যাতনেরও শিকার হতে হচ্ছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) পরিচালিত ‘সিস্টেম অফ ডাওরি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে বাংলাদেশের যৌতুক প্রথা নিয়ে ১০ বছরের এক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক ও মানসিক নির‌্যাতনের শিকার হন। অথচ যৌতুকের বিরুদ্ধে দেশে কঠোর আইন রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় অপরাধীরা নির্দ্বিধায় এ ঘৃণ্য অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কম সময়ে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য অনেক স্বামীই যৌতুককে সহজ পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এ জন্য তারা সর্বোচ্চ পর‌্যায়ের অপরাধে জড়াতেও দ্বিধাবোধ করছেন না।

বর্তমানে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও একাধিক নারীকে যৌতুকের জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে নির‌্যাতিত হতে হচ্ছে। এদের কেউ কেউ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করছেন তো কেউ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে রক্ষা পাচ্ছেন! যৌতুকের কারণে অনেক সময় অন্তঃসত্ত¡া গৃহবধূকেও প্রাণ দিতে হচ্ছে। এর ফলে একসঙ্গে দুটি প্রাণের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, যৌতুকের কারণে ২০১৩ সালে মোট ৩১৮ জন নারী নির‌্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে ১৬৩ জনের নির‌্যাতনের পর মৃত্যু হয়। ২১ জন আÍহত্যা করেন। এই সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদন বলছে, একই কারণে ২৯৬ জন নির‌্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে ৫০ জনের নির‌্যাতনের পর মৃত্যু হয়। আর ৫ জন আÍহত্যা করেন। আসক-এর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে, এখন পর্যন্ত যৌতুকের জন্য ২০৮ জন নারী নির‌্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে ১২৯ জন নির‌্যাতনের পর মারা যান এবং ৯ জন আÍহত্যা করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সময় দেশে যৌতুক বিষয়ে সরকারের সতর্ক অবস্থান ও নারী সংগঠনগুলোর সোচ্চার ভূমিকার কারণে যৌতুকজনিত নারী নির‌্যাতনের ঘটনা কমে এসেছিল। কিন্তু সরকারের যথাযথ নজরদারির অভাবে এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন নারী সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীদের উদাসীনতায় এখন যৌতুকের জন্য নারীদের ওপর নির‌্যাতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস এসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান প্রতিবেদককে বলেন, যৌতুক বন্ধে দেশে বর্তমানে দুটো আইন রয়েছে। প্রথম আইনটি হচ্ছে- ১৯৮০ সালের ‘যৌতুক নিরোধ আইন’। এ আইনে যৌতুকের কারণে নির‌্যাতনকারীদের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের শাস্তির বিধান রয়েছে। দ্বিতীয় আইনটি হচ্ছে ‘নারী শিশু নির‌্যাতন দমন আইন-২০০০ ও সংশোধনী ২০০৩-এর (গ) ধারা’। এ আইনের আওতায় একজন অপরাধীর শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে গত ৬ নভেম্বর বিয়ে হয় পিতৃহীন তাসলিমা জান্নাত কলির। কিন্তু যৌতুকের জন্য ৯ নভেম্বর রাতেই কলির ওপর তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অমানুষিক নির‌্যাতন চালায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের øাতকোত্তর ওয়াহিদা সিফাত। বেকার স্বামী মোহাম্মদ আসিফের জন্য বাবার বাড়ি থেকে ২০ লাখ টাকা এনে দেওয়ার চাপ ছিল সিফাতের ওপর। কিন্তু টাকা না দেওয়ায় সিফাতকে হত্যা করা হয় এমন অভিযোগে সিফাতের চাচা মিজানুর রহমান থানায় মামলা করেন। অথচ এর ৫ বছর আগে আসিফকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সিফাত। চলতি বছরের ২৯ মার্চ সিফাতকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত অবস্থায় নেওয়া হয়। তার সুরতহাল প্রতিবেদনে মাথা ও থুঁতনির নিচে জখমের প্রমাণ মেলে। তার চোখের পাশে জমাট রক্ত ছিল। সিফাতের দেড় বছরের একটি ছেলেও ছিল। জানা যায়, ২০ লাখ টাকার জন্য প্রায়ই সিফাতকে আসিফ নির‌্যাতন করতেন। দেশের আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’কে জানান, যৌতুক প্রতিরোধে দেশে প্রচলিত আইনগুলোই যথেষ্ট। শুধু প্রয়োজন এর সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সচেতনতা বাড়ানো। এ ছাড়া যৌতুকের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্তির জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। শুধু আইন দিয়ে যৌতুক বন্ধ করা সম্ভব নয়, এটি বন্ধ করতে পরিবার থেকেই শিশুদের যৌতুক বিষয়ে নিরুৎসাহিত করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দীন খান বলেন, যৌতুকের কারণে নির‌্যাতিত নারীরা অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় থাকেন। নির‌্যাতিত নারীরা তাদের নিজ পরিবার থেকেও খুব বেশি সহায়তা পান না। এ ক্ষেত্রে মামলার ব্যয়ভার বহনসহ নারীদের নিরাপত্তা দিতে দেশের বিভিন্ন এনজিও ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা যৌতুকের ব্যাপারে গণসচেতনতা তৈরি করতে পারেন এবং এর জন্য তারা আলাদা কমিটি গড়ে তুলতে পারেন।

সর্বশেষ খবর