বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জন্মভূমিকে চুমু খেয়ে চোখের জলে বিদায়

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

জন্মভূমিকে চুমু খেয়ে চোখের জলে বিদায়

জন্মভূমিকে চুমু খেয়ে চোখের জলে বিদায় নিলেন ১৫২ জন। তৃতীয় দফায় পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত দহলা খাগবাড়ি ছিটমহলের ৩০টি পরিবারের ১৫২ জন নতুন ভারতীয় নাগরিক স্থায়ীভাবে ভারতে চলে গেলেন। ১৫০ জন যাওয়ার কথা থাকলেও ২ নবজাতকসহ এ  সংখ্যা হয়েছে ১৫২ । এরমধ্যে ৬৩ জন পুরুষ, মহিলা ৪৯ জন এবং ২ নবজাতকসহ শিশু ৪০ জন। ‘আর কোনোদিন মাকে পাবো না’- কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন দহলা খাগরাবাড়ি ছিটমহলের শান্তি রায়। মা বাবাকে রেখেই চলে গেলেন তিনি। অপরদিকে ৬০ বছরের বৃদ্ধা  মায়া রায় মেয়েকে বিদায় জানালেন। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি  বলেন, ‘আর কোনো দিন মেয়ের মুখে মা ডাক শুনবো না। মেয়ের সঙ্গে কি আর দেখা হবে বাহে?’ বোদেশ্বরী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো ঝরনা হেমরন। বন্ধুরা বিদায় জানাতে এসেছিল তাকে। কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, ‘বাবা-মা সবাই চলে যাচ্ছে। তাই আমাকেও যেতে হচ্ছে। তবে স্কুলের কথা কোনোদিন ভুলব না আমি।’ মাধবী রানীরও কেউ রইল না এ দেশে। মা ভাইবোন সবাই চলে গেল। বাংলাদেশের চিলাহাটি ইউনিয়নের মেয়ে মাধবী রানীর বিয়ে হয় দহলা খাগরাবাড়ি ছিটমহলে। ২ দিন আগেই সন্তান প্রসব করেছেন তিনি। শারীরিক দুর্বলতাও কাটেনি তার। একাদশী রাতে জন্ম বলে মেয়ের নাম রেখেছেন একাদশী রানী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নারীপোতা ভিটে ছাড়তে হলো একাদশীকে । কাথা জড়ানো মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমুতে ঘুমুতে পাড়ি জমাল নতুন দেশে নতুন ঠিকানায়। চিলাহাটির ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তে আব্দুর রউফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে গতকাল বিকালে হলদিবাড়ী সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন তারা। এর আগে সোমবার বিকালে   প্রয়োজনীয় মালামালসহ দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে স্থাপিত চেকিং ও লোডিং পয়েন্টে আনা হয় তাদের। কাস্টমস ও বিজিবি কর্তৃপক্ষের চেকিং কার্যক্রমের পর সেখানে তাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা করা হয়। গতকাল সকালে দেবীগঞ্জ চেকিং ও লোডিং পয়েন্ট থেকে ৪টি বাস ও ৮টি ট্রাকে মালামালসহ নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তে রওয়ানা দেন তারা। এসময় পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ গোলাম আযম, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের ১ম সচিব রমা কান্ত গুপ্ত, দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। শেষ বিদায়ের ক্ষণে আত্মীয়-স্বজন এবং বিদায়ী ভারতীয়রা কান্নায় ভেঙে পড়েন। অসংখ্য উৎসুক মানুষও বেদনার্ত হয়ে পড়েন। সীমান্তের ওপারে তাদের অভ্যর্থনা জানান ভারতের কোচবিহার জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আইশা রানী। এ পর্যন্ত পঞ্চগড় থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ভারতে গেলেন ৩৪৭ জন । বাকিরা আগামী ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ছাড়বেন।

কুড়িগ্রাম থেকে গেলেন ৩০ পরিবার : ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দফায় কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহলের ৩০টি পরিবারের ১৫৮ জন মানুষ ভারতে গেছেন। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা চোখের জলে ভারতগামীদের শেষ বিদায় জানান। এ সময় কান্নার রোল পড়ে যায়। সৃষ্টি হয় এক বেদনাঘন পরিবেশ। বিদায় বেলা তারা নিজেরা কাঁদেন অন্যদেরও কাঁদান। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় বাগভাণ্ডার বিজিবি ক্যাম্পের কাছে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার ৯৬২-এর ১এস এর পাশ দিয়ে নতুন এ নাগরিকদের ওপার থেকে ফুলেল শুভেচ্ছায় স্বাগত জানানো হয়। বাগভাণ্ডার সীমান্তে এসব ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিদায় অভ্যর্থনা জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রফিকুল ইসলাম সেলিম, ৪৫ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল জাকির হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দিন, ভুরুঙ্গামারী ইউএনও মামুন ভূইয়া, ফুলবাড়ীর ইউএনও নাসির উদ্দিন মাহমুদ, নাগেশ্বরীর ইউএনও আবু হায়াত মো. রহমত উল্লাহ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোলেহ মারুফ, নবি নেওয়াজ, ওসি জিয়া লতিফ, সাবেক ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা প্রমুখ। তারা মিষ্টি খাইয়ে এবং ফুল ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিয়ে ১৫৮জন ভারতীয় নাগরিককে বিদায় জানান।

সর্বশেষ খবর