সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কাঁচা টাকা উড়ে কাঁচা বাজারে

লাকমিনা জেসমিন সোমা

কাঁচা টাকা উড়ে কাঁচা বাজারে

রাজধানীর কারওয়ানবাজারের কাঁচাবাজারে উড়ে কাঁচা টাকা। অবৈধ পার্কিং বাণিজ্য থেকে শুরু করে পদে পদে চলছে চাঁদাবাজি। দখলবাজদের দৌরাত্ন্যে চার লেনের রাস্তার তিন লেনই চলে গেছে অবৈধ দখলে। এতে একদিকে যেমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বাজারের ব্যবসায়ীরা, অন্যদিকে ভোগান্তিতে পড়ছেন সেখানে পথ চলতি সাধারণ মানুষ। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে গড়ে ওঠা এই অপরিকল্পিত বাজারটি স্থানান্তরে ঢাকা উত্তর সিটি (ডিএনসিসি) সক্রিয় উদ্যোগ নিলেও নানা জটিলতায় তা আটকে আছে। কারওয়ানবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাইকারি ও খুচরা কেনাবেচার এই বড় বাজারটি ঘিরে দিন-রাত চলছে চাঁদাবাজি। দিনের বেলায় এক ধরনের চাঁদাবাজি। রাতের বেলায় আরেক ধরনের। তবে রাতের বেলায়ই অপরাধীদের দৌরাত্ন্যে বাজারটি বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। জানা গেছে, মধ্যরাতের পর থেকে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রাকবোঝাই শাক-সবজি ও ফলমূল নিয়ে হাজির হন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ট্রাক প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে একটি চাঁদাবাজ গ্রুপ। যারা রাতের বেলায় চাঁদাবাজি করে তারা আবার দিনের বেলায় সক্রিয় থাকে না। দিনের  বেলায় সক্রিয় থেকে অন্য আরেকটি গ্রুপ। তারা মূলত অবৈধ পার্কিং সুবিধার বিনিময়ে বিভিন্ন যানবাহনকে জিম্মি করে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে। আরও একটি গ্রুপ রয়েছে যারা ভাসমান হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। এ ছাড়া নিয়মিত মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দিয়ে চলতে হয় বৈধ আড়তদার ও অন্য ব্যবসায়ীদের। এসব নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন দিয়েছেন যেখানে বলা হয়েছে যে কোনো সময় এই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্নক অবনতি হতে পারে। এমনকি সেখানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির মতোও ঘটনা ঘটতে পারে। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, পেট্রোবাংলা অফিস থেকে জনতা টাওয়ার পর্যন্ত চার লেনের রাস্তা। কিন্তু বাস্তবে অবৈধ পার্কিং, পিকাপ বা ছোট ট্রাক স্ট্যান্ডসহ ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কারণে রাস্তার দুই পাশের অন্তত তিন লেনই দখল হয়ে আছে। মাঝখানের একটি সরু লেন দিয়ে কোনো রকমে চলাচল করছে যানবাহন। তারপরও ডান-বাম কোনো নিয়ম-কানুন মানার বালাই নেই। কেবল সড়কের পাশেই নয়, কেউ কেউ রাস্তার মাঝখানে গিয়ে কাঁচা শাক-সবজি বিক্রি করতে বসেছেন। এক ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘রাস্তার কোনায় এত জায়গা থাকতে মাঝখানে গিয়ে বসার সাহস পায় কোথা থেকে বুঝেন না? এর জন্য প্রতিদিন ১০০ টাকা দিতে হয়।’ কাকে চাঁদা দিতে হয় জানতে চাওয়া হলে শামসুল আলম নামে অপর এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, ‘যারা দিনভর গরিব মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলে আর রাতে মদ খায়, তাদের দিতে হয়।’ ক্ষোভ নিয়ে অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, মেয়র সাহেব এখান থেকে বাজার উঠিয়ে দিলেই ভালো। তাতে যদি এই চাঁদাবাজদের হাত থেকে মানুষ রক্ষা পায়।  উত্তর সিটির সম্পত্তি বিভাগ জানায়, মূলত ২০১৩ সাল থেকে তারা কারওয়ানবাজারে পার্কিং ইজারা দেওয়ার দায়িত্ব পায়। এরপর ওই বছর ২৮ নভেম্বর টেন্ডারের মাধ্যমে মেসার্স মমতাজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কাজী মোস্তফা ৮ লাখ ১৯ হাজার ৯০০ টাকায় সেখানে এক বছরের জন্য গাড়ি পার্কিং এর ইজারা নেন।

নিয়ম অনুযায়ী সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত যানবাহন ভেদে নির্ধারিত হারে টোল আদায় করতে পারবেন তিনি। এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেলের জন্য ঘণ্টাপ্রতি ২ টাকা ও অন্যান্য গাড়ির জন্য ঘণ্টাপ্রতি ১০ টাকা আদায় করার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, টোল আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-নীতিই মানেন না কাজী মোস্তফা ওরফে কালা মোস্তফা ও তার অনুসারীরা। এমনকি তার ইজারার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে। কিন্তু তারপরও তার বিশাল বাহিনী কারওয়ানবাজারকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে টোল আদায় করে। তার বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয় দুলাল, কালাম, ফারুক বিপ্লব নামে বেশ কয়েকজন স্থানীয় ক্যাডার। অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কাজী মোস্তফা উল্টো সিটি করপোরেশনের ওপর পাল্টা অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, আমি টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা পেলেও সিটি করপোরেশন কখনো মূল পার্কিংয়ের জায়গাটি আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেনি। গত ৩০-৩৫ বছর ধরেই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন মূল পার্কিংয়ের জায়গাটি বেদখল রয়েছে। তিনি কেবল বাজার সংলগ্ন জনতা টাওয়ার, কিচেন মার্কেট, আঞ্চলিক সিটি করপোরেশন অফিস এবং ওয়াসা ভবনের সামনের পার্কিং থেকে টোল তুলতে পারেন। বাকি সব বড় বড় পার্কিংয়ের জায়গাই প্রভাবশালীদের দখলে বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে গতকাল উত্তর সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কাজী মোস্তফাকে মাত্র এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি এই ইজারার আগে এবং পরে বছরের পর বছর ধরে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে সেখান থেকে টোল তুলছেন। তিনি জানান, পার্কিংয়ের জায়গা ভাড়া দেওয়ার জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে তারা নতুন ইজারাদার পেয়ে গেছেন। দু-এক দিনের মধ্যে এই নতুন ইজারাদারকে এটি বুঝিয়ে দেওয়া হবে। অন্যদিকে যারা রাস্তা দখল করে ব্যবসা করছেন তাদের বিষয়ে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (অঞ্চল-৫) অজিউর রহমান বলেন, নিয়মিতই আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছি। রাতে কেউ কেউ এই বাজার ঘিরে অবৈধ কর্মকাণ্ড করার চেষ্টা করে তাদের বিষয়েও পুলিশকে অবহিত করেছি। আশা করছি খুব শিগগিরই এর একটি সমাধান হবে। ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালে সর্বপ্রথম কারওয়ানবাজারের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সরিয়ে  নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এ লক্ষ্যে রাজধানীর মহাখালী, যাত্রাবাড়ী ও গাবতলী সংলগ্ন আমিনবাজারে প্রায় ৩৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্যবসায়ীদের জন্য মার্কেটও তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিলতায়, বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা ভেটো দেওয়ায় তা বানচাল হয়ে যায়। এরপর আর এমন জোরালো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। খুব সম্প্রতি উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক আবারও এ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এরই মধ্যে তিনি বাজার সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। পূর্বের সমস্যাগুলো সমাধানে দু-একদিন পরপরই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসছেন। আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষির মাধ্যমে একটি সমন্বিত সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছেন। এর আগে গত ১৭ নভেম্বর থেকে কারওয়ানবাজার এলাকার অবৈধ দোকানপাট ও হকার উচ্ছেদের নামে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ যেটি এখনো অব্যাহত রেখেছে। এরই মধ্যে প্রায় হাজার সংখ্যক হকার উচ্ছেদ সম্ভব হয়েছে। ডিএনসিসির একটি সূত্র বলছে, অবৈধ দোকানপাটের ব্যাপারে মেয়র আনিসুল হক অনেকটা কড়া সুরেই ব্যবসায়ীদের বলেছেন, নিজে থেকে সরিয়ে না নিলে, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবেন।  কাঁচাবাজারের অভ্যন্তরে অবস্থিত উত্তর সিটির আঞ্চলিক কার্যালয় (অঞ্চল-৫) থেকে জানা যায়, কারওয়ানবাজারে প্রায় আট একর জমির ওপর উত্তর সিটির মোট ৮টা বাজার রয়েছে। এর মধ্যে দুটি দোতলা মার্কেট। এই মার্কেটগুলোর অবস্থা বেশ জরাজীর্ণ। কাঁচা-পাকা মিলিয়ে বাকিগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এসব মার্কেটে গড়ে ওঠা সহস্রাধিক দোকান ছাড়াও রাস্তার ওপরে বসছে অসংখ্য ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা হকাররা।

সর্বশেষ খবর