সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কুখ্যাত দুই পলাতক খুনিকে কবে ফেরত আনা হবে

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

মির্জা মেহেদী তমাল

কুখ্যাত দুই পলাতক খুনিকে কবে ফেরত আনা হবে

মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যে দুই জল্লাদ সেই কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান এখনো ধরা পড়েননি। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এ দুই আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে অপরাধীদের দেশে ফেরত আনা হলেও বুদ্ধিজীবী হত্যার এই দুই খুনির ব্যাপারে এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সেই দুই খুনিকে ৪৫ বছরেও গ্রেফতার না করায় প্রশ্ন সর্বমহলে— দুই খুনিকে দেশে ফেরত আনা হবে কবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, এদের অবস্থান সম্পর্কে সরকার অবগত। যুক্তরাজ্যে তারা আলিশান জীবনযাপন করছেন। তবে নানা জটিলতায় তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। তারা বিদেশে অবস্থান করে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত পাঁচজনের বিরুদ্ধে দায়ের মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। দণ্ডিত এই পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের রায় এখনো কার্যকর হয়নি। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আগামী ৬ জানুয়ারি চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হবে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বিদেশে পলাতক। বাকি কাদের মোল্লা ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। বিদেশে পলাতক ১৮ বুদ্ধিজীবীর দুই খুনিকে দেশে ফেরত আনা হবে কবে— তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফেরত আনার বিষয়ে এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, বুদ্ধিজীবী হত্যার আংশিক অভিযোগ ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। একাত্তরে কবি মেহেরুননিসা ও সাংবাদিক আবু তালেবকে হত্যার দায়ে তিনি কারাদণ্ড পেয়েছিলেন। অন্য অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর এ রায় কার্যকর করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালের রায়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলেন এ দেশীয় চারজন। তারা হলেন— জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, একাত্তরে গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর কমান্ডার চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে (তত্কালীন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। আলবদর ও রাজাকাররা সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিত। আর বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করত। ট্রাইব্যুনালের রায় অনুসারে, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করতেন নিজামী ও মুজাহিদ। আর আলবদর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেন চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। একাত্তরে ‘বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের কসাই’ নামে পরিচিত আশরাফুজ্জামান ছিলেন ঘাতক বাহিনীর ‘চিফ এক্সিকিউটর’, আর মাঈনুদ্দীন ছিলেন ‘অপারেশন ইনচার্জ’। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলাটিকে সূত্র ধরে সংস্থা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ২০১০ সাল থেকে তদন্ত শুরু করে। এক বছরের বেশি সময় তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে প্রসিকিউশনের কাছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকেও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তাকে। সরকারের কাছে খবর রয়েছে, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আশরাফুজ্জামান খান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যামাইকায় আর চৌধুরী মাঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পালিয়ে রয়েছেন। তাদের মধ্যে চৌধুরী মাঈনুদ্দীন একাত্তরে ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাংবাদিক। স্বাধীনতার পর তিনি পাকিস্তান হয়ে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান। তিনি লন্ডনের টটেনহ্যাম মসজিদ পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান। তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান ছাত্রজীবন থেকে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তারা এ সংগঠনের হাইকমান্ডের সদস্য হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয় ইসলামী ছাত্রসংঘ। চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ছিলেন ওই বাহিনীর ‘অপারেশন ইনচার্জ’। আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন ‘চিফ এক্সিকিউটর’ বা ‘প্রধান জল্লাদ’। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা বাস্তবায়নে হাইকমান্ডের নির্দেশে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নামেন। তারা একে একে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে রায়েরবাজার ইটখোলা ও মিরপুর বধ্যভূমিতে মরদেহ ফেলে দেন। সূত্র জানায়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চৌধুরী মাঈনুদ্দীনকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে কথা বলা হচ্ছে। আলোচনা সাপেক্ষে যে কোনো আসামিকে ফেরত দিতে পারে যে কোনো দেশ। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বন্দীবিনিময় চুক্তিও লাগে না। ফলে এখন ঢাকা-লন্ডনের আলোচনার ওপরই নির্ভর করবে চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের ফেরতের বিষয়টি।

মামলার রায় : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এরপর গত বছরের ৩ নভেম্বর আরেক মামলায় একই ট্রাইব্যুনাল মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন। আর গত ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল-১ নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে নিজামী ও মুজাহিদ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। মুজাহিদের আপিল নাকচ করেন আপিল বিভাগ। এরপরই মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। নিজামীর আপিল শুনানি সম্পন্ন হয়েছে এখন আগামী ৬ জানুয়ারি চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হবে। তবে মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ নেই। যদিও এ ব্যাপারে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে একটি কমিটি হয়। এরপর একটি মাত্র মিটিং হয় কমিটির। বৈঠকে পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়াসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে মাঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে  বসবাস করছেন। তারা দুজনই সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। এ জন্য তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করা কঠিন হবে।

মামলা ধামাচাপা : ইতিপূর্বে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে দায়ের মামলা পরিকল্পিতভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রধান হন্তারক বলে আলোচিত আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামানকে। কিন্তু মামলার তদন্ত শুরু হতে না হতেই তা ধামাচাপা দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে হত্যা, অপহরণ ও ষড়যন্ত্রের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও আইনের ভুল ধারায় মামলা হয়েছে— এই কারণ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলাটির অপমৃত্যু ঘটানো হয়।

শহীদ গিয়াস উদ্দিনের বোন অধ্যাপক ফরিদা বানু ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রমনা থানায় প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধির ১২০(খ)/৪৪৮/৩৬৪/৩০২/ ২০১/৩৪/১১৪ ধারায় মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রধান হন্তারক আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামানকে। মামলাটি বুদ্ধিজীবী গিয়াস উদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় ২০০২ সালে। মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এভাবেই পার পেয়ে যান মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যার এই ঘাতকরা। এ ছাড়া আদালত মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দিলেও ঘাতকদের কখনোই সাজা ভোগ করতে হয়নি। তারা প্রত্যেকেই মুক্তি পেয়েছেন রাজবন্দি হিসেবে। আবার অনেক মামলাও তদন্তের আগেই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। শহীদ পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবেই ঘাতকদের রক্ষা এবং মামলাগুলো ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। মামলার পরিণতি সম্পর্কেও তাদের কিছু জানানো হয়নি।

সর্বশেষ খবর