বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
বিলুপ্ত ছিটমহল

মুক্ত জীবনে বিজয়ের স্বাদ

প্রতিদিন ডেস্ক

মুক্ত জীবনে বিজয়ের স্বাদ

এবারই প্রথম মুক্ত জীবনে বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করলেন বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। যেসব ছিটমহল মাত্র কমাস আগেও ছিল ভারতের অংশ, সেগুলো বাংলাদেশের ভিতরে বিলুপ্ত হওয়ার পর সেখানকার বাসিন্দারা গতকাল বাংলাদেশের বিজয় দিবসের উৎসবে শরিক হয়েছেন। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

পঞ্চগড়ের গারাতী : পঞ্চগড় জেলার সাবেক একটি ছিটমহল গারাতীতে নামকরা শিল্পীরা গতকাল বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। শতকণ্ঠে গেয়েছেন জাতীয় সংগীত। উৎসবের অনুষ্ঠান স্থলে সকাল থেকেই মানুষের ঢল নামে। জেলার নানা প্রান্তের মানুষও ছুটে আসেন। নারী শিশু থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

মঞ্চে তখন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সুরের ধারার শিল্পীরা প্রস্তুত। তাদের সঙ্গে পঞ্চগড়ের বিপি উচ্চবিদ্যালয় এবং বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মঞ্চে। সামনে হাজার হাজার দর্শক। তখন দুপুর ২টা ৩৯ মিনিটে হেলিকপ্টার যোগে অনুষ্ঠানে পৌঁছান সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এসেই মঞ্চে ওঠেন। এর আগে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান এবং পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম সুজন। অনুষ্ঠানের শুরুতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নেতৃত্বে ‘ধন ধান্যে পুষ্পেভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটির সঙ্গে সুরের ধারার শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন। এ অবস্থায় অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছান ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ছিটমহলবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘এতদিন আপনাদের দেশ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেষ্টায় আপনারা অবরুদ্ধ ছিটমহল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তার নেতৃত্বে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তারাই আজ বিদেশি হত্যা করছে। সাম্প্রদায়িক উগ্রতার সৃষ্টি করছে। ধর্মের নামে বুদ্ধিজীবী-লেখক থেকে শুরু করে মসজিদের মুয়াজ্জিন পর্যন্ত হত্যা করছে।’ পরে মঞ্চে ঘোষণা আসে—এবার জাতীয় সংগীত। লক্ষাধিক মানুষ দাঁড়িয়ে যান। অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। শুরু হয় জাতীয় সংগীত। ঐতিহাসিক এই মুহূর্তে লাখো মানুষ প্রাণ খুলে গাইলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। আবেগী হয়ে পড়েন বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিকরা। চিত্কার করে গাইতে থাকেন তারা। জীবনে প্রথম নিজের দেশের হয়ে জাতীয় সংগীত এভাবেই তারা প্রাণের আকুতি দিয়ে গাইলেন। কণ্ঠ মেলায় শিশুরাও। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে চ্যানেল আই। জাতীয় সংগীত শেষে মঞ্চে আসেন ডাক ও টেলি যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। তিনি বিলুপ্ত ছিটমহলে গ্রামীণফোনের থ্রিজি নেটওয়ার্ক উদ্বোধন করেন। বক্তৃতায় তারানা হালিম বলেন, ‘এই দেশের স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন, যিনি স্বাধীনতা এনেছেন— সেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে হবে।’ এর পর একে একে বক্তব্য রাখেন গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিব শেঠ, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান লিটা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জনপ্রেক্ষিত কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান মুক্তা, পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমদ, ১৮ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফুল হক। শেষে সুরের ধারার শিল্পীরা একে একে ‘আজি বাংলাদেশের হূদয় হতে’ ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ ‘ও আমার দেশের মাটি’ ‘বিষম দৈরার ঢেউ’ গানগুলো পরিবেশন করেন। সংগীতানুষ্ঠানের মাঝেই সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত কবিতা ‘আমার পরিচয়’ আবৃত্তি করেন মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জাগানো গান ‘নোঙ্গর তোল তোল সময় যে হল হল’ গানটি দিয়ে শেষ হয় ঐতিহাসিক এ অনুষ্ঠান।

দাশিয়ারছড়ায় উল্লাস : দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দীদশা থেকে মুক্তির পর কুড়িগ্রামের সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার নয়া বাংলাদেশিরা এবারই প্রথম ঘটা করে উদযাপন করলেন মহান বিজয় দিবস । ৪৫ বছরে এসে অতি আনন্দের সঙ্গে তারা দিনভর অনুষ্ঠানে মেতে ছিলেন। দাশিয়ারছড়ায় প্রস্তাবিত তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি দাখিল মাদ্রাসা ও দুটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে শতশত নারী ও পুরুষ বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য সকাল থেকে নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে এসে জড়ো হতে থাকেন। দাশিয়ারছড়ার প্রতিটি বাড়িতে উড়ানো হয় জাতীয় পতাকা। ছিটমহল আন্দোলনের নেতা গোলাম মোস্তফা খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘সমস্ত অর্জন বঙ্গবন্ধু ও তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার। তারাই মহান। আমরা অবিভূত, আনন্দিত। আজ ১৬ ডিসেম্বরে কোনো বাধা বিঘ্ন ছাড়াই স্বাধীনভাবে উদযাপন করা হলো বিজয় দিবস।’

ভিতরকুটিতে শ্রদ্ধা : দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দীদশা থেকে মুক্তির পর প্রথমবারের মতো ৪৪তম মহান বিজয় দিবস পালন করলেন সদ্য বিলুপ্ত লালমনিরহাটের অভ্যন্তরের ৫৯টি ছিটমহলের নতুন বাংলাদেশিরা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভিতরকুটি বাঁশপচাই ঈদগা মাঠে প্রতীকী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন নতুন বাংলাদেশিরা। এরপর জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় ছোট-বড়-নারী-পুরুষ সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’-তে কণ্ঠ মেলান। পরে ঢাকঢোল পিটিয়ে নেচে গেয়ে বিজয় দিবসের র‌্যালিতে যোগ দেন আবাল-বৃদ্ধবনিতা। র‌্যালি শেষে ওই ঈদগা মাঠে মহান বিজয় দিবসের তাত্পর্য তুলে ধরে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সদ্যবিলুপ্ত ১৫২ নম্বর ভিতরকুটি (বাঁশপচাই) ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সভাপতি হারুন-অর-রশীদের সভাপতিত্বে মহান বিজয়ের ৪৪ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ প্রশাসক অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কবি-সাহিত্যিক ফেরদৌসি বেগম বিউটি, বিলুপ্ত ভিতরকুটি ছিটের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী হাফেজা খাতুন ও রিনা খাতুন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর