মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চিকিৎসা যন্ত্রের সুবিধা পাচ্ছেন না রোগী

সাঈদুর রহমান রিমন

চিকিৎসা যন্ত্রের সুবিধা পাচ্ছেন না রোগী

সরকারি হাসপাতালে রোগ পরীক্ষার যন্ত্রগুলো হয় অকেজো, নয়তো খোলাই হয় না বছরের পর বছর। আবার সচল যন্ত্রপাতির সংযোজন থাকলেও তা চালানোর মতো টেকনিশিয়ান নেই সেখানে। এসব কারণে ঢাকার প্রায় সব সরকারি বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রসহ সারা দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সুযোগ-সুবিধা রোগীদের ভাগ্যে জুটছে না। ফলে ন্যূনতম রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে ক্যান্সার নির্ণয় পর্যন্ত যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপরই নির্ভরশীল হচ্ছে।

কোটি কোটি টাকা দামের এসব সরঞ্জাম কিনে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে কিন্তু বেশিরভাগ যন্ত্রের মোড়ক পর্যন্ত খোলা হয়নি। যেসব যন্ত্রপাতির মোড়ক খোলা হয়েছে সেগুলো চালানোর মতো দক্ষ জনবল নেই সেখানে। আবার যেখানে টেকনিশিয়ান রয়েছে সেখানে নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। থাকলেও সেগুলো বছরের পর বছর ধরে বিকল করে ফেলে রাখা হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে রোগীদের বেশি টাকা খরচ করে যেতে হয় বেসরকারি ক্লিনিকে। আর এসব ক্লিনিকে রোগ পরীক্ষা করে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাই।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ১২ কোটি টাকা দামে কেনা ল্যাসিক মেশিনটি রোগীদের চিকিৎসার কাজে লাগছে না। চাহিদা না থাকলেও তিন বছর আগে ডিজিটাল কম্পিউটারাইজ রেডিওগ্রাফি নামে একটি মেশিন সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। কোটি টাকা মূল্যের ওই মেশিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তরের পর থেকেই অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চারটি লাইনাক মেশিনের একটি পড়ে আছে বিকল হয়ে, অন্য তিনটি লাইনাক ও দুটি কোবল্ট মেশিন চালানো হচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। আর কোবল্ট মেশিনগুলো ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরনো এবং অনেকটা নিম্নমানের হওয়ায় এগুলো দিয়ে রোগীর প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

রাজধানীর একটি অন্যতম চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্যার সলিমুল্লাহ  মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের বেশির ভাগ সময়ই বিকল থাকে জরুরি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনসহ অন্যান্য সব মেশিন ডিজিটাল হলেও সেগুলো অনেক আগের। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের বেশির ভাগ চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে হাসপাতালের বাইরের প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে রোগীদের রেফার করেন। হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটি বছরে পর বছর ধরে নষ্ট থাকে বলে কর্মচারীরা জানিয়েছেন। বর্তমানে সিটিস্ক্যান ও ক্যাথল্যাব মেশিনটিও বিকল হয়ে গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইটিটি বছরের পর বছর বন্ধ থাকে। ইকো মেশিন কখনো সচল কখনো অচল। এনজিওগ্রামের যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে আছে। সিটি এমআরআই, সিটিস্ক্যান মেশিনও নষ্ট। ফলে রোগীদের বাইরে থেকে বাড়তি টাকায় এসব টেস্ট করতে হচ্ছে। সরকারিভাবে হাসপাতালে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সচল রয়েছে মাত্র একটি। এই একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে হাজার হাজার রোগীর সেবা করাটা অসম্ভব। ফলে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে হাসপাতালে। মিটফোর্ড হাসপাতালের কলেজ ভবন, হাসপাতাল ভবন ও কিং অ্যাডওয়ার্ড ভবনের বেশির ভাগ লিফটই দিনে কয়েকবার বিকল হয়ে যায়। লিফটগুলোর ওপরে রয়েছে কয়েক স্তরের ময়লার আস্তরণ। বছর দেড়েক আগে লিফটে প্রায় দেড় ঘণ্টা আটকে থেকে মারা যান একজন রোগী। এ ঘটনায় কয়েকজনকে বরখাস্ত করা হলেও লিফটগুলো সংস্কার করা হয়নি। সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসমূহে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসা সরঞ্জাম বিকল কিংবা অব্যবহূত পড়ে আছে নানা জটিলতায়। এর অনেকগুলো আবার অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। যন্ত্রপাতির এমন বেহাল ও যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি নিয়ে এখন ত্যক্ত-বিরক্ত খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক্স-রে মেশিন ও অ্যাম্বুলেন্স বিকল থাকছে। একই সঙ্গে প্রায় ১০ বছর আগে কেন্দ্রীয়ভাবে বিতরণ করা এক্স-রে মেশিনগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে অনেক হাসপাতালে। হাড়ের অপারেশনে ব্যবহার হয় দুই কোটি টাকা মূল্যের সিআর মেশিন। আট মাস আগে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে পাঠানোর পর এটি মাত্র ৫-৭ দিন ব্যবহার হয়েছে। হাসপাতালটিতে চোখ নিরীক্ষার জন্য অর্থাল মসকপ ও অপারেটিভ মাইক্রোসকোপ আর হার্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ইসিজি যন্ত্র থাকলেও তা ব্যবহার হয় না। তাই রোগীদের ছুটতে হয় ক্লিনিকে ক্লিনিকে। হূদরোগের চিকিৎসায় জয়পুরহাটের রোগীদের যেতে হয় বগুড়া, রাজশাহী বা ঢাকায়। মার্চের শুরুতে জয়পুরহাট হাসপাতালে কার্ডিয়াক মনিটর, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফি ও ইসিজিসহ ১০টি দামি যন্ত্র পাঠানো হলেও তা এখনো চালু হয়নি। বরগুনার জেনারেল হাসপাতালে এনেসথেসিয়া করার যন্ত্রপাতিগুলো একটি কক্ষে সাত বছর ধরে তালাবদ্ধ রাখা আছে।

সরকারি যন্ত্রপাতি ওষুধ বেসরকারি হাসপাতালে : ১৯৮৬ সালে জাপান সরকারের অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল। রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দিতে সেখানে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে জাপান। তবে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটেনি ওই সরঞ্জামে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা। কারণ জেনারেল হাসপাতালের ওই আধুনিক যন্ত্রপাতি গিয়ে বসে বেসরকারি ক্লিনিকে; কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেটের গড়া ক্লিনিকে। অব্যবস্থাপনার সুযোগে ওই সিন্ডিকেট শুধু যন্ত্রপাতিই নয়, দিনের পর দিন চুরি করছে সরকারি ওষুধ। বিক্রি করে দিয়েছে হাসপাতালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেশিন। হাসপাতালের চিকিৎসকরাও তাদের কাছে জিম্মি।

হাসপাতালে ৫৮৫ যন্ত্র বাক্সবন্দী : দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ, জেলা ও সদর হাসপাতাল এবং উপজেলা হাসপাতালে কোটি কোটি টাকা দামের ৫৮৫টি চিকিৎসা সরঞ্জাম গুদাম ঘরে পড়ে আছে বছরের পর বছর। বাক্সবন্দী এসব চিকিৎসা সরঞ্জাম বিভিন্ন সরকারের আমলে হাসপাতালগুলোতে পাঠানো হয়েছে। অনেক যন্ত্র মোড়কের ভিতরে থেকেই নষ্ট হয়ে গেছে। বাক্সবন্দীর তালিকায় অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্রের সংখ্যাই বেশি। অস্ত্রোপচারের আগে রোগীকে এ যন্ত্রের সাহায্যে অচেতন করা হয়। ২০০৩ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সিএমএসডি ৫২টি হাসপাতালে ৫৫টি এ যন্ত্র পাঠিয়েছিল। জেলা হাসপাতালগুলোর কর্মকর্তারা জানাতেও পারেননি যন্ত্রপাতিগুলো এখন কোথায় কী অবস্থায় আছে। সিএমএসডি ২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ২৪টি জেনারেটর জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে পাঠায়। এর একটিও চালু নেই। চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে আরও রয়েছে হাইড্রোলিক ওটি টেবিল (৫৪টি), ডেলিভারি টেবিল (১৮টি), ইনকিউবেটর (৩৬টি), হট এয়ার বাথ (৪৫টি), অটোক্লেভ যন্ত্র (৫৪টি), অস্ত্রোপচার বাতি, জরুরি বাতি (৭১টি), সার্জিক্যাল ডায়াথার্মি যন্ত্র (১০টি), এক্স-রে যন্ত্র (২২টি), শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (২৯টি), ব্লাড ব্যাংক রেফ্রিজারেটর ও ক্রাইয়ো ফ্রিজার (১২টি), বেবি ইনকিউবেটর (১৬টি), ফটোথেরাপি যন্ত্র (২২টি), ডেন্টাল চেয়ার ইউনিট (১৪টি) এবং অন্যান্য যন্ত্র (১০৩টি)। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় নেদারল্যান্ডসের সিমিড ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট সার্ভে’ নামে একটি জরিপ করে। তাতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা কর্মসূচির আওতায় কেনা চিকিৎসা যন্ত্রপাতির ৫০ শতাংশ ব্যবহার হয়। ১৬ শতাংশ যন্ত্রের মোড়কই খোলা হয়নি। ১৭ শতাংশ নষ্ট। বাকি ১৭ শতাংশ ব্যবহার উপযোগী হলেও ব্যবহার করা হয় না।

সর্বশেষ খবর