মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিদ্রোহে বেকায়দায় নৌকা, গ্রুপিংয়ে জর্জর বিএনপি

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ

বিদ্রোহে বেকায়দায় নৌকা, গ্রুপিংয়ে জর্জর বিএনপি

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশাল উপজেলা। কবি তার কৈশোরের একটা সময় কাটিয়েছেন এখানেই। পরবর্তীকালে তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবি নামে সুখ্যাত হন। ত্রিশালের পরিচিতিতে ভিন্নতা পেয়েছে। বিদ্রোহী কবির ত্রিশালে এখন নৌকার প্রার্থীর প্রধান সমস্যা নিজ দলের বিদ্রোহী। ফলত ত্রিশাল আওয়ামী লীগ অনেকটা বেকায়দায়। অন্যদিকে গ্রুপিংয়ে জর্জরিত বিএনপি। বিএনপির একটি অংশ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে। একদিকে আওয়ামী লীগের একটি অংশ অন্যদিকে বিএনপির একটি অংশ সমানতালে স্বতন্ত্র প্রার্থী জগ প্রতীকের পক্ষে থাকায় অনেকটা পাল্লা ভারীতে রয়েছেন বর্তমান মেয়র এ বি এম আনিছুজ্জামান। তবে নৌকার প্রার্থীর দাবি, আওয়ামী লীগে নেই কোনো কোন্দল। যারা অসন্তুষ্ট তারা ভোটের আগেই নৌকায় চলে আসবেন। বিএনপিন প্রার্থী বলছেন ভিন্ন কথা। বলছেন, বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধভাবেই ধানের শীষের পক্ষে কাজ করছে। আর এতে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। তবে অনেক নেতা পদ টিকিয়ে রাখতে নৌকার পক্ষে গণসংযোগ করলেও পেছনে পেছনে বলছেন বিদ্রোহী প্রার্থীর কথা। অন্যদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে এমন ভয়ে রয়েছেন সাধারণ ভোটাররা। ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌরসভা নির্বাচন অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে একটু ভিন্ন। এখানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দেশের সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী জাহিদুল ইসলাম জুয়েল সরকার। আর ধানের শীষের প্রার্থী আমিনুল ইসলাম আমিন, স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) জগ প্রতীকের এ বি এম আনিছুজ্জামান আনিছ, স্বতন্ত্র প্রার্থী নারকেল গাছ প্রতীকের সিরাজুল ইসলাম মণ্ডল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপির পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী আনিছুজ্জামানের প্রচারণায় কমতি নেই। উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অনেক নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী আনিছুজ্জামানের জন্য কাজ করছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। ত্রিশাল উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় অনেক নেতা রয়েছেন যাদের বাড়ি ত্রিশাল ও ময়মনসিংহে। আর এদের মধ্যে ডা. লিটনের একটি গ্রুপ ধানের শীষের পক্ষে চুপচাপ রয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী জুয়েল সরকার দুষছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আনিছকে আবার আনিছ দুষছেন জুয়েলকে। বিএনপির আমিনুল কিন্তু কাউকেই দুষছেন না। এদিকে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছেন। তবে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী আনিছের পক্ষেই রয়েছেন বলে জানান একাধিক নেতা। অন্যদিকে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ধানের শীষের পক্ষে চুপিসারে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। ত্রিশালের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির এবং উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপির। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকলেও এখানে নেই কোনো সরকার দলের জনপ্রতিনিধি। তাই আওয়ামী লীগ পৌর মেয়র পদটি নিজেদের আয়ত্তে নিতে মরিয়া। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী একক থাকায় তাদের মধ্যে জয় সম্পর্কে আশাব্যঞ্জক মনোভাব দেখা যায়। কিন্তু ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ধানের শীষের পক্ষে কাজ করতে দেখা যায়নি। ত্রিশাল উপজেলা ছাত্রদল ও পৌর ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে বহুদিন ধরে। একদিকে উপজেলা বিএনপির সভাপতি অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক। ত্রিশাল উপজেলা বিএনপির সভাপতি ডা. মাহবুবুর রহমান লিটন। তিনি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য। ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে কোনো মুখ খোলেননি। এ বিষয়ে জানতে ডা. মাহবুবুর রহমান লিটনের মুঠোফোনে বার বার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এদিকে ত্রিশাল পৌর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাব্বির আহমেদ রনি বলেন, কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও নির্বাচন নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই। ময়মনসিংহ জেলা বিএনপি (দক্ষিণ) সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন না। ধানের শীষের লড়াই হবে জগের সঙ্গে। কেন্দ্রীয় যুবদলের সহসাধারণ সম্পাদক শাহ শিব্বির আহমেদ বুলু বলেন, তারা ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন। ধানের শীষের প্রার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, আপনাকে কে পাঠিয়েছে। বিএনপি বা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কোনো নেতা না অন্য কেউ। আমরা তৃণমূল নেতারা ঐক্যবদ্ধ আছি। জানা গেছে, পৌর এলাকার ৭৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৩০ কিলোমিটার পাকা রয়েছে। তবে পাকা রাস্তাটুকুও চলাচলের অনুপযোগী। সাড়ে ১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৌরসভার বেশির ভাগই গ্রাম। সূত্র জানায়, পৌর মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন চারজন। এদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ জাহিদ হাসান জুয়েল মনোনয়ন পাওয়ায় জ্যেষ্ঠ নেতারা ক্ষুব্ধ। এতে আওয়ামী লীগে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জগ প্রতীকের আনিছুজ্জামানের সঙ্গে ত্রিশাল কৃষক লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান আলমগীর, আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম, সাবেক যুবলীগ নেতা হুমায়ুন কবির, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম, ছাত্রলীগ নেতা পারভেজ, আশরাফুল ইসলামসহ অনেক নেতা গণসংযোগ করছেন। এদিকে ত্রিশাল উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক সবুজ বলেন, আমরা নৌকার পক্ষে কাজ করছি। হয়তো কেউ কেউ আনিছের পক্ষে ভোট চাচ্ছেন, তাতে কোনো কাজ হবে না। গতকাল ত্রিশাল পৌর এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জুয়েল সরকার ১ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন। পরে বিকালে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে তিনিও অংশ নেন। সন্ধ্যায় বাজারে একটি পথসভাও করেন।

বিএনপির প্রার্থী আমিনুল ইসলাম নিজ বাড়ির পাশে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে একটি কর্মিসভা করেন। দুপুরে কেন্দ্রীয় নেতা ওসমান ফারুক জেলা ও উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিয়ে শহরে গণসংযোগ করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী আনিছুজ্জামান সকাল থেকে ২, ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গণসংযোগ করেন। পরে দক্ষিণ চরপাড়ার মহিলাদের একটি সভায় অংশ নেন। ত্রিশাল ট্রাকস্ট্যান্ডের একটি চা স্টলে বসে ষাটোর্ধ্ব আবদুল মালেক বলেন, ভাই, ৯ (নয়) সংখ্যার একটি জিনিস তিনজনকে যদি সমানভাবে দেওয়া হয়, তাহলে সবাই ৩ করে পাবেন। আর ত্রিশালে তো আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী একজন নৌকা, অন্যজন জগ। তাই আমরা দুই ভাগে সমানভাবে ভোট দিব। উপজেলা পরিষদের সামনের এক দোকানি বলেন, আওয়ামী লীগও যেই, বিএনপিও হেই। কারে যে ভোট দিমু বুঝবার পারতাছি না। সিরাজুল ইসলাম নামে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মী জানান, কে প্রার্থী অইলো জানার দরকার নাই, হাসিনার নৌকা পাইছি এতেই অইব। ত্রিশাল বাজারের পান দোকানি রাইসুল ইসলাম বলেন, মাইনসে কয় হুনতাছি, মতিন সরকারের দুই পোলা, জুয়েল সরকার ও আমিন সরকার। এক পোলা পাস করলেই অইল। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাহিদ হাসান জুয়েল সরকার বর্তমানে ত্রিশাল উপজেলা যুবলীগের সভাপতি, ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক তিনি। তার বাবা আবদুল মতিন সরকার ত্রিশাল থেকে একবার সংসদ সদস্য ও একবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বিএনপির প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীকের আমিনুল ইসলাম উপজেলা যুবদলের সদস্য ও তার বড় ভাই আতাউর রহমান শামীম উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। তার বাবা ত্রিশাল পৌরসভার সাবেক মেয়র মরহুম আবদুর রশিদ। স্বতন্ত্র প্রার্থী আনিছুজ্জামান ত্রিশাল উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি। তার বাবা আবুল হোসেন ত্রিশাল উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক।

ত্রিশাল পৌর নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ৯ ওয়ার্ডে ১১টি কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ১০টিই ঝুঁকিপূর্ণ। মোট ভোটার ২১ হাজার ৯৫৩ জন। পুরুষ ১১ হাজার, মহিলা ১০ হাজার ৯৫৩। মেয়র পদে চারজন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৩২ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ১৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সর্বশেষ খবর