রবিবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রীয় গ্রেনেডে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ মৃত্যুপুরী

মির্জা মেহেদী তমাল

রাষ্ট্রীয় গ্রেনেডে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ মৃত্যুপুরী

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বিকাল ৫টা ২২ মিনিট। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের সন্ত্রাসবিরোধী সভায় বক্তৃতা শেষ করলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা।

সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার উদ্বোধন করবেন তিনি। চারদিকে মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। ঠিক ওই মুহূর্তেই শুরু হয় পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা। পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। শত শত মানুষের আর্তচিত্কার, ছড়িয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত আর পোড়া গন্ধ; ঝলসে যাওয়া মানুষের দেহ থেকেও ধোঁয়া বেরুচ্ছে। গোটা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ তখন এক মৃত্যুপুরী। পোড়া মানুষের গন্ধে সেখানকার বাতাস ভারি। মানববেষ্টনীতে প্রাণে রক্ষা পাওয়া শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করেও চলে গুলিবর্ষণ। আহতদের সাহায্য করার বদলে বিক্ষুব্ধ এবং আহত মানুষের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা ও কাঁদানো গ্যাস ছোড়ে তত্কালীন সরকারের পুলিশ। মুহূর্তের মধ্যে দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে সবাই।

এগারো বছর আগে ঠিক এভাবেই সন্ত্রাসবিরোধী সভায় নজিরবিহীনভাবে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। আর এই গ্রেনেড হামলা চালানো হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। হামলায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয় বেরিয়ে আসে সর্বশেষ তদন্তে। সরাসরি হামলার সঙ্গে জড়িতদের সহায়তা করেছেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সংস্থার কর্ণধাররা। শুধু তাই নয়, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরাও জানতেন অনেক কিছু। শুধু হামলা নয়, পরবর্তীতে মামলার আলামত নষ্ট করার প্রক্রিয়াতেও তারা সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে ‘জজমিয়া নাটক’ সাজিয়ে ইতিহাসের ভয়াবহ এই হামলার ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। আর আসামি গ্রেফতারে কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে নিজেরাই সেই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দেয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার এ ঘটনাটি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। নারকীয় ওই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী। যাদের অনেককেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। তদন্তে জানা গেছে, ওই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। তাকে উদ্দেশ্য করেই পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে রক্ষা পেলেও আহত হন। একটি কানের শ্রবণশক্তি হারান তিনি।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এবং মামলার চার্জশিট, অন্যান্য নথি পর্যালোচনা করে ঘটনার নানা তথ্য জানা গেছে। ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার পর ২০০৮ সালের ১১ জুন গ্রেনেড হামলা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের দুটি মামলায় প্রথম ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরে মামলার বিচারকালে তৎকালীন সরকার ঘটনার অধিকতর তদন্তের আবেদন করে। ওই আবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিচারিক আদালত ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ দুটি মামলায় অধিকতর তদন্ত করেন। প্রায় দুই বছর পর তিনি ২০১২ সালে অধিকতর তদন্তের প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। বর্তমানে মামলা দুটির বিচারকার্য শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন পিপি আবু আবদুল্লাহ ভূইয়া। তিনি গতকাল বলেন, এখন সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ড চলছে। শিগগিরই মামলার রায় হবে বলে আশা করেন তিনি। 

অভিযুক্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থা : রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা উদ্ঘাটিত হয় মামলাটির অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে সম্পৃক্ত ষড়যন্ত্রকারীদের নাম ও কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। সম্পূরক চার্জশিটে অন্য যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা হলেন, সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স, ডিএমপির তত্কালীন উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান, সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, হুজির আমির মাওলানা শেখ ফরিদ, হুজির নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মাওলানা আবদুর রউফ, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার (বরখাস্ত), হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির (আইডিপি) আহ্বায়ক মাওলানা আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আবদুল মাজেদ বাট ওরফে ইউসুফ বাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, সিআইডির সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ ওরফে পরিবহন হানিফ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, বাবু ওরফে রাতুল বাবু, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন প্রমুখ। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের দুটি মামলায় তদন্ত প্রতিবেদনে আরও যারা আসামি তারা হলেন— মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, সাবেক এমপি মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন আসামি করা হয়েছে। নতুন করে ৩০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করায় এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া প্রথম অভিযোগপত্রে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়েছিল। গতকাল ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিশেষ পিপি আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া জানান, মামলার ২৯৩ কার্যদিবসে প্রায় ৪০০ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৭৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

হামলাকারীদের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন বাবর-তারেক : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশগ্রহণকারীদের হামলার সময় প্রশাসনিক সাহায্য ও নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর ও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। এ নিয়ে হাওয়া ভবনে বৈঠক করেন তারা। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষ্য দেওয়ার সময় এসব কথা বলেন মেজর (অব.) আতিকুর রহমান। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আতিকুর রহমান জানান, তিনি ২০০৪-০৯ পর্যন্ত র্যাব সদর দফতরে গোয়েন্দা শাখার উপ-পরিচালক (ইন্টারোগেশন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ওই শাখার পরিচালক ছিলেন কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ। পরবর্তীতে তিনি বিডিআর বিদ্রোহে নিহত হন। ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের ছোট ভাই অভিকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিনই ঢাকার মেরুল বাড্ডা থেকে মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করা হয়। মুফতি হান্নানের গ্রেফতারের বিষয়টি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরকে জানানো হলে তিনি সন্তুষ্ট হননি।  

যেভাবে রাষ্ট্রীয় সংস্থা : ঘটনার সময় ডিজিএফআইর জঙ্গিবাদ দমন-সংক্রান্ত ব্যুরোতে কর্মরত ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মিজানুর রহমান। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ডিজিএফআইয়ের তত্কালীন কতিপয় কর্মকর্তা কীভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িত হুজি নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, তার বিবরণ দিয়েছেন। এ ছাড়া ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের সাবেক দুই প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম যে ২১ আগস্টের ঘটনায় জড়িত তা মামলার দ্বিতীয় দফার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানও। মুফতি হান্নান তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘২০০৪ সালের আগস্ট মাসের শুরুতে সিলেটে গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে ঢাকার মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভার সংবাদ জানতে পারি। সেখানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পুনরায় তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত হয়। আমি, মাওলানা আবু তাহের, শেখ ফরিদ, মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা রশিদসহ আল মারকাজুলের গাড়িতে করে হাওয়া ভবনে যাই। সেখানে হারিছ চৌধুরী, লুত্ফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, ব্রিগেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিমকেও উপস্থিত পাই। কিছুক্ষণ পর তারেক রহমান আসেন। আমরা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর হামলার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তাদের সহায়তা চাই। তখন তারা আমাদের প্রশাসনের সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন।’ ২১ আগস্টের হামলার পর ডিজিএফআই তাজউদ্দিনকে ভুয়া পাসপোর্টে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়। পুরো ঘটনার সঙ্গে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কিছু কর্মকর্তা জড়িত থাকলেও এ বিষয়ে সবাই অবহিত ছিলেন না। ঘটনার পরদিন সংস্থার প্রধান তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওই ঘটনার তদন্ত করার অনুমতি চান। বেগম জিয়া তাকে এই বলে নিবৃত্ত করেন যে, তার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, এ বিষয়ে তদন্তের জন্য একটি কমিটি করে দেওয়া হবে।

আলামত নষ্ট : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঘটনাস্থলের সব আলামতই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হয়। ঘটনাস্থলে চারটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পাওয়া গিয়েছিল, যার দুটি ওই রাতে আর দুটি পরদিন ধ্বংস করে ফেলা হয়। গ্রেনেডের গায়ে অপরাধীদের আঙ্গুলের ছাপ থাকার কথা কিন্তু গ্রেনেডগুলো ধ্বংস করার সঙ্গে সঙ্গে তাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঘটনাটি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা তাৎক্ষণিক থানায় মামলা করতে গেলে উপরের নির্দেশ না থাকায় মামলা নিতে থানা অস্বীকার করে।

সর্বশেষ খবর