শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

জনস্রোতের আছড়ে পড়া ঢেউয়ে আনন্দের ঝিলিক

মোস্তফা মতিহার

জনস্রোতের আছড়ে পড়া ঢেউয়ে আনন্দের ঝিলিক

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গতকাল ছিল শিশুপ্রহর —বাংলাদেশ প্রতিদিন

টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর। রাস্তার দুই পাশেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো জনতা। হৃদয়ের গহিন থেকে নিসৃত আনন্দের ঝিলিক চোখেমুখে। জনস্রোত আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশকদের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে সফলতা ও আনন্দের হাসি। গতকাল প্রথম ছুটির দিন পেয়েছে গ্রন্থমেলা। বরাবরের মতো প্রথম ছুটির দিনে এবারও মেলার দ্বার খুলেছে বেলা ১১টায়। গতকাল ছিল মেলার প্রথম শিশুপ্রহর। মেলার দ্বার উন্মোচনের আগে সকাল সাড়ে ৮টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এরপর বেলা ১১ থেকে ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহরে আনন্দে মেতে ওঠে শিশুরা। মেলায় ঘোরাঘুরি করে অভিভাবকের কাছ থেকে পছন্দের বইটিও আদায় করে নেয় শিশুরা। শিশুদের জন্য বাংলা একাডেমি এবার বেশ কয়েকটি নতুন বই প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি ছোটদের অভিধান-এর নতুন সংস্করণ, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই সম্পাদিত ‘আমার প্রথম লেখা’, আখতার হুসেন সম্পাদিত ‘হাবীবুর রহমান কিশোর রচনাসংগ্রহ’, সৈয়দ শামসুল হকের বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা বইয়ের সাধারণ ও ব্রেইল সংস্করণ, আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, বেবী মওদুদের ‘রাসেলের গল্প’, শাহজাহান কিবরিয়ার ‘আফ্রিকার রূপকথা’ এবং ‘চালাক শিয়াল ও বোকা শিয়াল’। একুশের টানে শাণিত হয়ে মেলায় বইপ্রেমীরা শুধু মেলাকে সরগরমই করে তুলেননি, বই কিনেছেন স্টল ঘুরে ঘুরে। তবে লোকে লোকারণ্য মেলায় ছিল ধুলার ছড়াছড়ি। আর ধুলায় ধূসর এই মেলা রীতিমতো ভুগিয়েছিল বইপিয়াসীদের। ধুলার কবল থেকে রক্ষায় এ সময় অনেককেই মাস্ক পরে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। শিশুপুত্র মুয়াজকে নিয়ে রাজধানীর মানিকদী থেকে মেলায় এসেছেন সেলিনা পারভীন মম। তিনি বলেন, প্রিয় লেখকের পছন্দের বই কেনার জন্য প্রতিবারই মেলায় আসি। অন্য বছর আরও পরে আসা হলেও এবার একটু আগে আসা হয়েছে। কয়েক দিন পর স্বামীর কর্মস্থল ফ্রান্সে চলে যাবেন বলেই এবার একটু আগে আগে মেলায় আসা। মেলার সার্বিক পরিবেশ সম্পর্কে মম বলেন, এবারের মেলার পরিধি অন্যবারের তুলনায় অনেক বেশি। অনেক মানুষ এসেছে তাই খুব ভালো লেগেছে। তবে ধুলাতে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। এত বড় একটা আয়োজনে লোক বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলা একাডেমি কেন পানি ছিটাচ্ছে না এ নিয়েও আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি। পাইরেটেড বই বিক্রির ব্যাপারে বাংলা একাডেমি কঠোর অবস্থানের কথা জানালেও গতকাল পঞ্চম দিনেও মেলায় ছিল পাইরেটেড বইয়ের ছড়াছড়ি।  সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরের ফুটপাথে বেশ কয়েকজন দোকানি পাইরেটেড বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন। আর স্লোগান দিয়ে অর্ধেক রেটে পাইরেটেড বই বিক্রি করছিলেন দেদার। মেলা শুরুর আগে একাডেমি কর্তৃপক্ষ অনেক কথা বললেও পাইরেটেড বইয়ের অভিযানে একবারও মেলা পরিচালনা কমিটিকে নামতে দেখা যায়নি।

গতকাল বিকালে মেলা পরিদর্শনে আসেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এবারের মেলায় মন্ত্রীর সাংবাদিকতা জীবন নিয়ে ‘যখন সাংবাদিক ছিলাম’ নামের একটি বই প্রকাশ করেছে চারুলিপি প্রকাশনী। চারুলিপির স্টলে বসে নিজের বইয়ের ক্রেতাদের অটোগ্রাফ দেন ওবায়দুল কাদের। নতুন বই সম্পর্কে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘এ বই নতুন নয়। পুরনো লেখার নতুন মুখ। আমি যখন সাংবাদিক ছিলাম তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখতাম। ওগুলোরই একটি সংকলন এ বই।’ আগামী বছর তার নতুন উপন্যাস আসছে বলেও জানান সেতুমন্ত্রী। তবে চমক রাখার জন্য নাম প্রকাশ করেননি।

নতুন বই

তথ্য কেন্দ্রের হিসাব মতে, গতকাল মেলায় ২৫৬টি নতুন বই এসেছে। এর মধ্যে গল্প ৪০, উপন্যাস ৪৯, প্রবন্ধ ৮, কবিতা ৬৪, গবেষণা ৪, ছড়া ৮, শিশুসাহিত্য ১৩, জীবনী ৮, মুক্তিযুদ্ধ ৪, নাটক ১, বিজ্ঞান ৩, ভ্রমণ ৪, ইতিহাস ৫, রাজনীতি ৪, কম্পিউটার ১, ধর্মীয় ২, অনুবাদ ১, অভিধান ৫, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ২ এবং অন্যান্য বিষয়ে ৩০টি।

উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে— ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের ‘বাংলা ভাষা আন্দোলন’ ময়ূরপঙ্খি ও ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নির্মলেন্দু গুণের ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’, আবুল আহসান চৌধুরীর ‘অন্নদাশঙ্কর রায় : মন-মননের পত্রালি’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘যখনি জাগিবে তুমি’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘রেশমি’, হাসান হাফিজের ‘আট দেশের রূপকথা’,।

মূল মঞ্চের আয়োজন

বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী : অভিধান ও ব্যাকরণ কর্মসূচি, অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক স্বরোচিষ সরকার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক হাকিম আরিফ এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আহমদ কবির। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে ‘বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টসের শিল্পীরা। সংগীত পরিবেশন করেন আবদুল লতিফ শাহ্, শফি মণ্ডল, রণজিৎ দাস বাউল, মমতা দাসী বাউল, ভজন কুমার ব্যাধ ও কোহিনুর আকতার গোলাপী।

নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় নয় : ডিএমপি কমিশনার

গতকাল বিকালে গ্রন্থমেলা পরিদর্শনে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি পুরো মেলা প্রাঙ্গণের ভিতর-বাইরে পরিদর্শন করেন। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই জানিয়ে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘মেলার নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি নেই। পুরো মেলা প্রাঙ্গণে মোট ৭টি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। দুরবিন দিয়ে তারা সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। এ ছাড়া সিসি ক্যামেরায় সব ভিডিও ফুটেজে প্রত্যেক দর্শনার্থীর আগমন-নির্গমন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’ মেলায় প্রবেশের সময় সব ধরনের তল্লাশি করা হচ্ছে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘এবার প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথ বেশি হওয়ায় মেলায় ঢুকতে ও বের হতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন টিম নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ফুট প্যাট্রল টিম, মোটর প্যাট্রল টিমসহ আরও টিম।’

সর্বশেষ খবর