শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেড়েছে অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য

সর্বস্ব হারাচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষ

সাখাওয়াত কাওসার

বেড়েছে অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য

গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলের সামনের ফুটপাথ। ইফতারের পর ফুটপাথের ওপর ছটফট করছেন মোফাজ্জল হোসেন (৩০) নামের এক সিএনজি অটোরিকশা চালক। কথা বলার শক্তি ক্রমেই হারাচ্ছিলেন তিনি। এ দৃশ্য দেখে এগিয়ে আসা পথচারীদের ক্ষীণকণ্ঠে বলছিলেন, ইফতারের সময় গুলিস্তানে শরবত খেয়েছিলেন। একপর্যায়ে অটোরিকশাতে থাকা যাত্রীরাই তাকে ফেলে দিয়ে সিএনজিটি নিয়ে পালিয়েছে। একপর্যায়ে জ্ঞান হারান মোফাজ্জল। পথচারীরাই গুরুতর অবস্থায় তাকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। এর কিছুক্ষণ পর রাত পৌনে ১০টার দিকে আশকোনা কসাইবাড়িতে প্রায় একইভাবে আক্রান্ত হয়ে নিজের সিএনজি অটোরিকশা খোয়ান চালক শিমুল (৩১)। পরে আরেক অটোরিকশা চালক তাকে গুরুতর অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এরকম প্রায় প্রতিদিনই ঢামেক এবং মিটফোর্ড হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে আগত রোগীর সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ জন। এর কিছুদিন আগে গত মার্চ মাসে আফতাব উদ্দিন নামে এক মুক্তিযোদ্ধা অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন।

বিশেষ করে ঈদকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বেড়েছে অজ্ঞান পার্টি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। এ চক্রের সদস্যদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। গণপরিবহনে যাত্রীবেশে, পথচারী কিংবা বিভিন্ন পেশার ছদ্মবেশে তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা। প্রায় প্রতিদিনই মহানগরীর গুলিস্তান, তিন বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালসহ জনাকীর্ণ এলাকায় পথচারী ও যাত্রীদের অজ্ঞান করে সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ জানান, সাধারণত ঈদ কেন্দ্রিক অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের তত্পরতা বাড়ে। খুব শিগগিরই এ সংক্রান্তে অভিযান শুরু হবে। সব সময়ই এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয় র‌্যাব।

পুলিশ ও হাসপাতালসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গেল এক মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে সঙ্গে থাকা সর্বস্ব হারানোসহ অসুস্থ হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ। মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক, সাংবাদিক, পুলিশ, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, ছাত্র, শিক্ষক কেউই এদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। বিভিন্ন সময় অনেকে গ্রেফতার হলেও কয়েক দিনের মাথায় তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই অপরাধে জড়াচ্ছে। তবে নতুন করে আবারও অজ্ঞানপার্টির বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর বাস-লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলওয়ে স্টেশনসহ জনাকীর্ণ অন্তত শতাধিক পয়েন্টে অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের পাঁচ শতাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছে। চেতনানাশক মেশানো জুস, ডাবের পানি, খেজুর, ঝাল-মুড়ি, শরবতসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করছে অপরাধচক্রের সদস্যরা। গেল ছয় মাসে কেবল চেতনানাশক ডাবের পানি পান করেই অজ্ঞান হয়ে মারা গেছেন দুজন। গেল ঈদ ও দুর্গাপূজায় ঢাকা মহানগরীতে পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারী-অজ্ঞানপার্টির সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল। এতে করে কিছুদিন এই চক্রের সদস্যরা বিশ্রামে থাকে। তবে এর কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় তাদের কার্যক্রম।

পুলিশ ও ভুক্তভোগীরা জানান, অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা নগরীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, বনানী-কাকলী, মগবাজার, মতিঝিল, পল্টন, গুলিস্তান, নয়বাজার, বাবুবাজার, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, উত্তরার আবদুল্লাহপুর এবং মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় বেশি তত্পর থাকে। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত মার্চে অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের খপ্পরে পড়ে অসুস্থ হয়ে পরদিন ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন মারা যান। তিন নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন রাজধানীর দক্ষিণখানের আইনুসবাগে ভাড়া বাসায় থাকতেন। ঘটনার দিনে সকালে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা তুলতে গাজীপুরের শ্রীপুরে গিয়েছিলেন। টাকা তুলে ঢাকায় ফেরার পথে তিনি বাসে অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়েন। পরে অচেতন অবস্থায় বাসচালক বঙ্গবাজার এলাকায় নামিয়ে দেন। আফতাবের মানিব্যাগ থেকে পাওয়া কাগজপত্রের সূত্র ধরে পথচারী সেলিম খবরটি স্বজনদের জানান। তবে চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় এখনো পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, সম্প্রতি শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে কোনো অপরাধীর রেহাই নেই। এর বাইরেও নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অজ্ঞানপার্টির বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্বের মধ্যে আছে।

অজ্ঞান পার্টির সদস্য গ্রেফতার : গত রবিবার রাত ৯টার দিকে আদাবরের মেহেদীবাগ ও ঢাকা হাউজিংয়ের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ডলার প্রতারণা ও অজ্ঞান পার্টির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সাতজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরা হলো সুবান মিয়া (মাসুদ), এনায়েত মিয়া ও আজগর শেখ, খিজির মোল্লা, আজিজুল মোল্লা, ফায়েজ শেখ ও নজরুল ইসলাম। পুলিশ জানায়, এদের কাছ থেকে নগদ ১ লাখ দুই হাজার ৫২৫ টাকা, বেশ কিছু সৌদি রিয়াল ও অজ্ঞান করার মলম উদ্ধার করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর