শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

গতি পাচ্ছে জ্বালানি খাতের মেগা প্রকল্প

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র, রামপাল পাওয়ার প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল, পায়রা পাওয়ার প্লান্ট, মহেশখালী কয়লাভিত্তিক প্রকল্প, মাতারবাড়ী কোল পাওয়ার প্রজেক্ট

জিন্নাতুন নূর

জ্বালানি খাতের মেগা প্রকল্পগুলো গতি পেতে শুরু করেছে। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটির কাজে অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে স্থান সনদ প্রাপ্তিকে একটি ‘মাইলস্টোন’ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতরাও এর কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে বলে আশা করছেন। এ ছাড়া রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণেরও ক্ষেত্রে ভারত থেকে ভারী যন্ত্রাংশ আমদানিতে কর অব্যাহতি দেওয়ায় কেন্দ্রটি নির্মাণে সৃষ্ট জটিলতার অবসান ঘটেছে। কিছুদিন আগেই কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনাল নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হবে। তবে সরকারের গৃহীত এই মেগা প্রকল্পগুলোর কয়েকটির কাজ শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছু বেশি সময় লাগতে পারে বলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা মনে করছেন। এরই মধ্যে এ প্রকল্পগুলোর কয়েকটির জমি অধিগ্রহণ, স্থানীয়দের ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ যাতে যথাসময়ে শেষ হয় এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তা মনিটর করছেন।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র : সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের স্থান সনদ বা সাইট লাইন্সেস দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পাবনার ঈশ্বরদীর নির্বাচিত স্থানে এ বিদ্যুেকন্দ্র তৈরি  করতে আর কোনো আপত্তি থাকছে না। বিদ্যুেকন্দ্রটি করতে স্থানটি উপযুক্ত বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। মাটি, পানি, বাতাস, ভূমিকম্পসহ ৬৩ ধরনের পরীক্ষা করে এ সনদ দেওয়া হয়েছে। এখন বিদ্যুেকন্দ্রটি স্থাপনের কাজ পুরোদমে চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে এ লাইন্সেস হস্তান্তর করে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২২ সালে এবং একই ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৩ সালে চালু হবে। সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট বুঝে নেবে যথাক্রমে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে এক লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি (১ হাজার ২৬৫ কোটি মার্কিন ডলার), যা বাংলাদেশে এযাবৎ সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্প। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় অবস্থিত এই পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়, বেশ কিছু অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়েছে। যে জায়গায় চুল্লি স্থাপিত হবে, সেখানে বালি ও মাটি ফেলে উপযোগী করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ—কর্মকর্তাদের অফিস নির্মাণ, আবাসন, ল্যাবরেটরি, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার স্থান ইত্যাদি—মিলিয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হবে ডিসেম্বরে। ২০১৭ সাল থেকে বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের মূল কাজ শুরু হবে। বিদ্যুেকন্দ্রটি এক হাজার ৬২ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে প্রতিটি স্তরেই সতর্ক মনিটরিং হচ্ছে। এই বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার প্রকল্প পরিচালক পাভেল ভালসভ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি ২০১৬ সালে অবকাঠামোগত নির্মাণকাজের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ করতে পারব। আমরা খুব কঠোরভাবে নির্মাণকাজের সময়সূচি মেনে চলছি। কাজের গতি ধরে রাখতে পারলে আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করতে পারব বলে আশাবাদী।’

রামপাল মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্প : এরই মধ্যে বিদ্যুেকন্দ্রটির ভারী যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর কর অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে মাটি ভরাটের কাজ শেষ পর্যায়ে। মূল বিদ্যুেকন্দ্রের ফেন্সিং কাজ শেষ হয়েছে। জিও টেকনিক্যাল সার্ভের কাজ হয়েছে। টাউনশিপ ৬০০ থেকে ৮০০ পরিবারের জন্য আবাসিক এলাকা নির্মাণের কাজ চলছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের মাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জয়েন্ট ভেঞ্চার বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে রামপালের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভা নিয়মিত করা হচ্ছে। প্রকল্পটি রোডম্যাপ অনুযায়ী বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হচ্ছে। বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনসট্রাকশন (ইপিসি) চুক্তি ও ফিন্যানশিয়াল ক্লোজিং দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কো. লিমিটিডের (১৩২০ মেগাওয়াট) উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণে মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (চুক্তি) স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর মধ্যে এ প্রকল্পে ক্ষতিপূরণের জন্য ২৪৭টি চেক হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রকল্প সাইটে যাওয়ার রাস্তা চার লেন তথা প্রশস্তভাবে তৈরির জন্য বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্টের কাছে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রামপাল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনসট্রাকশন (ইপিসি) চুক্তি প্রক্রিয়া হতে যাচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে।

মাতারবাড়ী আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল পাওয়ার প্রজেক্ট : জয়েন্ট ভেঞ্চারে তৈরি হতে যাওয়া সিপিজিসিবিএর ও সুমিতোমা করপোরেশন, জাপানের যৌথ উদ্যোগে মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটির চুক্তির ওপর লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং পাওয়া গেছে। কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ। এ জন্য পরামর্শক নিয়োগের কাজ চলছে। অধিগ্রহণকৃত জমির সীমানাপ্রাচীরের কাজ শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া অস্থায়ী ডাম্পিং এরিয়া, সেডিমেন্টেশন সার্ভে সম্পাদন, সাইট অফিস, হেলিপ্যাড নির্মাণ, পরিবেশগত জরিপ ইত্যাদির কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য মোট এক হাজার ৪১৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের কাজও শুরু হয়েছে। আশা করছি ২০২১ সাল নাগাদ এর কাজ সম্পন্ন হবে।’

এলএনজি টার্মিনাল : সম্প্রতি কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনাল নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। বুধবার এ অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে এ টার্মিনাল থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহের কথা রয়েছে। প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করবে টার্মিনালটি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাকে আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী এ টার্মিনাল থেকে গ্যাস কিনতে হবে। ৩১ মার্চ মহেশখালীতে দেশের প্রথম এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি এস্ট্রা অয়েল অ্যান্ড এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে ‘টার্মিনাল ইউজ অ্যাগ্রিমেন্ট’-এ অনুস্বাক্ষর করে পেট্রোবাংলা। ২০১৪ সালের ২৬ জুন তাদের সঙ্গে পেট্রোবাংলা এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করে। সরকার ২০১০ সালে এ প্রকল্প নিয়েছিল। সব ঠিক থাকলে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে জাহাজে করে আমদানি করা গ্যাস এই টার্মিনাল হয়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট : পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিতব্য এই তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলেছে। উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের বিশাল এলাকাজুড়ে এখন চলছে এর কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে বেড়িবাঁধ ও বালু ভরাটের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে হেলিপ্যাড, ওয়াচ টাওয়ার ও ভিভিআইপি গেস্টহাউস। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চেক বিতরণ ও ভূমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত কাজ সহজ করার জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা হয়েছে। বিদ্যুেকন্দ্রটি যৌথভাবে নির্মাণ করছে দক্ষিণাঞ্চল, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)। প্রায় এক হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নসহ এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৮২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে ধানখালী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের ১৩৮টি ঘর সরানো হয়েছে। এ গ্রামগুলোর অন্তত ১২০০ পরিবারের প্রায় এক হাজার একর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতি শতাংশে ৫ হাজার ৭৮৫ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মহেশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক প্রকল্প : কক্সবাজারের মহেশখালীতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য যৌথ মালিকানা চুক্তি আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। যৌথ মালিকানাধীন এ কোম্পানির ৫০ শতাংশ মালিকানা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। আর ৫০ শতাংশের মালিকানা থাকবে মালয়েশীয় তেনেগা ন্যাশনাল বারহেদ কোম্পানি ও দেশটির পাওয়ার টেক এনার্জি এসিজেএন বিএইচডির। মালয়েশীয় সরকার এরই মধ্যে বিষয়টির অনুমোদন দিয়েছে। এবার বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার অনুমোদন মিলেছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের পর উভয় দেশের মধ্যে এ চুক্তি সম্পাদিত হবে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) মহেশখালী দ্বীপে জমি অধিগ্রহণ শুরু করেছে। তেনেগা, মালয়েশিয়া ও বিউবোর যৌথ উদ্যোগে মহেশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট প্রকল্পেও সুপার ক্রিটিক্যাল বয়লার ও ক্লিন কোল ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদনে রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল (আরএফপি) এর মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে।

সর্বশেষ খবর