বুধবার, ১০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

দেশীয় শিল্প ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র

মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে ক্যাপটিভ গ্যাসের দাম ১৩০ ভাগ বাড়ানোর পাঁয়তারা

রুহুল আমিন রাসেল

মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে ক্যাপটিভ গ্যাসের দাম ১৩০ শতাংশ বাড়িয়ে শিল্প ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, দেশীয় শিল্প-কারখানা ধ্বংস করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধের মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চক্রান্ত চলছে। শিল্প গ্রাহকেরা গ্যাস না পেলেও অবৈধ লাইনে গ্যাসের অভাব নেই। ক্যাভটিভ গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে প্রায় তিন হাজার শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া বাড়বে উৎপাদন ও নিত্যপণ্যের খরচ। সরকার প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অযৌক্তিক প্রস্তাব।

জানা গেছে, গ্যাস ক্ষেত্রে রাষ্ট্র-পরিচালিত পরিবেশক ছয়টি কোম্পানির কাছ থেকে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন—বিইআরসি। কোম্পানিগুলো গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার্য গ্যাসের দাম ১৪০ শতাংশ, ক্যাপটিভ বিদ্যুেকন্দ্রের গ্যাসের দাম ১৩০ শতাংশ, শিল্পে ব্যবহূত গ্যাসের দাম ৬২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম ৭১ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাব পেয়ে মূল্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিইআরসি-তে গত ৭ আগস্ট শুরু হওয়া প্রকাশ্যে গণশুনানি চলবে আগামী ১৮ আগস্ট পর্যন্ত। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যয়, বিদ্যুৎ, সার, কৃষি ও নিত্যপণ্য এবং পরিবহন খাতে খরচ বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন—এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিছু লোক সরকারকে ভুল বুঝিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। কারণ— ভবিষ্যতে এলএনজি আনার পর গ্যাসের দাম অনেক বাড়বে, এই কথা বলে এখন দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। এখন দাম বাড়ালে বস্ত্র খাতের অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।

এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদও মনে করেন, সিরামিক ও টেক্সটাইলসহ রপ্তানি খাত এখনো গ্যাস চালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের ওপর নির্ভরশীল। কারণ, সরকার গুণগত মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। রানা প্লাজা ধস, তাজরীন গার্মেন্টে  অগ্নিকাণ্ড ও গুলশান হামলার ঘটনায় বারবার বাংলাদেশের সুনামহানি হচ্ছে। সব মিলিয়ে রপ্তানি খাত অস্বস্তিতে রয়েছে। এ অবস্থায় আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে যখন বিদেশিদের মনে প্রশ্ন জাগছে, তখন গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছাতে পারে। সরকার গ্যাসের দাম বাড়াতে চাইলে, তাতে আমরা রাজি আছি। তবে এখন সেই সময় নয়। এ জন্য অন্তত এক-দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে সরকারকে। এফবিসিসিআই সভাপতির মতে, আমদানি বিকল্প শিল্প-কারখানাগুলোও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ভয়ে চাপের মধ্যে রয়েছে। কারণ, এতে তাদেরও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। আর এখন ব্যাংক ঋণের সুদের হার যে কমতির দিকে রয়েছে, মূল্যস্ফীতি বাড়লে, তাও বেড়ে যাবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্তত দু-এক বছর পর গ্যাসের দাম সহনীয় পর্যায়ে বাড়ানো হলে শিল্প এ চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে। না হলে যে আঘাত আসবে, তা শিল্প খাত সহ্য করতে পারবে না। এফবিসিসিআইর সাবেক প্রথম সহসভাপতি জসিম উদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ক্যাপটিভ গ্যাসের দাম ১৩০ শতাংশ বাড়ানো হলে শিল্প-কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে উৎপাদিত পণ্যের দাম। রপ্তানিকারকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সব মিলিয়ে বর্তমানে যে ৩ থেকে ৪ হাজার শিল্প-কারখানা ক্যাপটিভ পাওয়ারে চলে, সেগুলো গভীর সংকটে পড়বে। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, দেশে মোট ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে বর্তমানে ২১টি থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে, প্রতিদিন ২ হাজার ৭১৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর বিপরীতে চাহিদা রয়েছে, প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। সে হিসাবে গ্যাসের ঘাটতি প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই সংকটের পরও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনায় গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকা ব্যবসায়ীদের দাবি— গ্যাসের দাম বাড়ানোর বদলে সরাসরি ব্যবসায়ীদের কম দামে জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগ দেওয়া হোক। এমন প্রেক্ষাপটে গত ২৯ মার্চ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোং লিমিটেড প্রাকৃতিক গ্যাসের গ্রাহক পর্যায়ের মূল্য এবং কোম্পানির বিতরণ মার্জিন পুনর্নির্ধারণ প্রস্তাবে বলেছে, ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস ট্যারিফ প্রতি কিউবিক ঘন মিটার ৮ দশমিক ৩৬ থেকে ১৯ দশমিক ২৬ টাকা করা হোক। অর্থাৎ মূল্য বৃদ্ধির হার হবে ১৩০ শতাংশ। ক্যাপটিভি গ্যাসের ট্যারিফ বৃদ্ধির কারণ বিশ্লেষণ করে বিটিএমএ বলেছে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের আগামী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রতি কিউবিক ঘনমিটার গ্যাস ট্যারিফে এক বছরের ব্যবধানে মূল্য বৃদ্ধি হার দাঁড়াচ্ছে ৪৫০ শতাংশের মতো। যা বিশ্বে নজিরবিহীন বলে মনে করেন বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন—বিটিএমএ সভাপতি তপন চৌধুরী। তিনি গত ৮ আগস্ট বিআইআরসি চেয়ারম্যান এ আর খানকে দেওয়া পত্রে আরও বলেন, বস্ত্র খাতের শিল্প ২৪ ঘণ্টাই চালু রাখতে ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতি কিউবিক ঘন মিটার গ্যাসের ট্যারিফ ছিল ২ দশমিক ৮২ টাকা। যা টেক্সটাইল খাতের জন্য ছিল একটি প্রত্যক্ষ প্রণোদনা। পরবর্তীতে গ্যাস ট্যারিফ ২ দশমিক ৮২ থেকে প্রতি কিউবিক ঘন মিটার ৪ দশমিক ১৮ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর পরও তা টেক্সটাইল খাতের জন্য প্রণোদনা হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ক্যাপটিভ খাতে গ্যাস ট্যারিফ প্রতি কিউবিক ঘন মিটার ৪ দশমিক ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩৬ টাকা। অর্থাৎ ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে আমাদের যে সুবিধা ছিল তা বাধাগ্রস্ত হয়। এরপরও সব শিল্প-কারখানা ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মাধ্যমে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্প পরিচালনা করে আসছে, তা আবার আকস্মিক এক বিপর্যয়কর অবস্থার সম্মুখীন। যদিও বর্ধিত গ্যাস ট্যারিফ অনুপাতে তাদের তৈরি ইয়ার্ন ও ফেব্রিকের দাম বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ওই পত্রে আরও বলা হয়, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাতের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধির জন্য সরকারের বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মাত্র এক বছরের কম সময়ের মধ্যে গ্যাস ট্যারিফ ৪৫০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাতের বিদ্যমান প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ও সক্ষমতা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ বর্তমানের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। বরং বাজার হারাবে। রপ্তানিতে যে মূল্য সংযোজন হতো তা কমবে। বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার সুফল প্রতিযোগী দেশ ভোগ করবে। তিতাস শিল্প খাতে ব্যবহূত গ্যাস ট্যারিফ প্রতি ঘন মিটার ৬ দশমিক ৭৪ টাকা থেকে ১০ দশমিক ৯৫ টাকায় নির্ধারণের যে প্রস্তাব করেছে, তাতে ট্যারিফ বৃদ্ধির হার হচ্ছে ৬২ শতাংশ। বিটিএমএ বলেছে, সরকার প্রয়োজনীয় ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারার কারণে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনপূর্বক মিল বা শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হয়। বস্ত্র খাতের বৃহদাকার স্পিনিং, উইভিং এবং ডাইয়িং প্রিন্টিং ফিনিশিং মিলের অধিকাংশই ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে গ্যাসই হচ্ছে একমাত্র জ্বালানি।

ভোক্তা অধিকার আদায়ে সোচ্চার কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ—ক্যাব উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম মনে করেন, তিতাসসহ অন্য গ্যাস কোম্পানিগুলো লাভেই রয়েছে। তারপরও অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের ব্যয় কিছুটা বেড়েছে। এখন জনগণের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে এই ঘাটতি মেটাতে চায়। এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি জানান, তিতাস এখনই সব ব্যয় বাদে বছরে ৪০০ কোটি টাকার মতো লাভ করছে। কর্মীরা কয়েকটি বোনাস পাচ্ছে। তাই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।

এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রস্তাবের প্রতিবাদে বিইআরসি’র চলমান গণশুনানিতে প্রতিদিনই তুমুল হৈচৈ, বাকবিতণ্ডা ও হট্টগোল হচ্ছে। ক্ষুব্ধ অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন খোদ বিইআরসি শীর্ষ কর্মকর্তরা। গণশুনানিতে ক্যাপটিভ পাওয়ারের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। আবারও দাম বাড়ানো এক ধরনের প্রতারণা। শুনানিতে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ— সরকার শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে না পারায় বাধ্য হয়ে শিল্প মালিকরা ক্যাপটিভ পাওয়ারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্প চালান। কিন্তু ১১ মাসের মাথায় দ্বিতীয় দফায় ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম বাড়ানো শিল্প ধ্বংসে ষড়যন্ত্রের শামিল। এতে প্রায় ৩ হাজার শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতে পারে। তাতে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হবে। শুনানিতে অংশ নেওয়া গ্রাহকদের অভিযোগ— বাতাস দিয়ে তাদের কাছ থেকে গ্যাসের দাম নিচ্ছে তিতাস। ফলে তিতাসের কোনো সিস্টেম লস নেই। বরং তারা দশমিক ২২ শতাংশ ‘সিস্টেম গেইন’-এ আছে। আবার অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠানে ইভিএম মিটার স্থাপন করা হলেও সক্রিয় (অ্যাকটিভেট) করা হচ্ছে না। ফলে শিল্প-গ্রাহকদের বাতাস কেনার সময় বেড়ে চলেছে। শিল্প-গ্রাহকেরা গ্যাস পান না। অথচ অবৈধ লাইনে গ্যাসের অভাব নেই। অল্প চাপের কারণে যে গ্যাস সরবরাহ করা হয় না, তার দাম নেওয়া কতটা নৈতিক এবং যৌক্তিক সেই প্রশ্নও তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, গতবছর সেপ্টেম্বরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় বিইআরসি তিতাসের মুনাফার হার কমিয়ে দেওয়ায় লাখ লাখ শেয়ার ব্যবসায়ী রাস্তায় বসেছেন। অনেক বিদেশি শেয়ারবাজার ছেড়ে চলে গেছেন। অপরদিকে গ্যাসের প্রস্তাবিত মূল্যবৃদ্ধির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি—ডিসিসিআই বলেছে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর বদলে, কম দামে জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগ দেওয়া হোক। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে সমুন্নত রাখতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে ডিসিসিআই বলেছে, দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যবসায় খরচ বাড়বে। বাধাগ্রস্ত হবে রপ্তানি খাত। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ—এফডিআই আকর্ষণে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সার্বিকভাবে স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হতে পারে বলে মনে করছে ডিসিসিআই।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি—এমসিসিআই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অযৌক্তিক আখ্যায়িত করে বলেছে, গ্যাসের প্রস্তাবিত মূল্যবৃদ্ধি গৃহীত হলে পরিবহন খরচ, বাণিজ্য ক্ষেত্রে উৎপাদন ও আনুষঙ্গিক সব খরচ, বিদ্যুৎ ও সারসহ সব উৎপাদন খরচ, কৃষিপণ্য এবং সর্বোপরি নিত্যপণ্যের খরচসহ নানাবিধ খরচ বাড়বে সাধারণ মানুষের। এই অপরিকল্পিত গ্যাসের দাম বৃদ্ধি তৈরি পোশাকশিল্পসহ অনেক খাতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বাধাগ্রস্ত করবে। এমনকি এতে ভিশন ২০২১ সামনে রেখে বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

এমসিসিআই বলেছে, শুধু মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে গ্যাসের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব নয়। বরং মিটারে গরমিল, গ্যাস সংযোগের অসাধু ব্যবহার, অসাধু উপায়ে বিল কমিয়ে দেওয়া বা অবৈধ সংযোগের বিষয়গুলো বন্ধ করে পরিস্থিতির সুরাহা করা সম্ভব। এমসিসিআই বিভিন্ন পরিসংখ্যান উল্লেখ্য করে বলেছে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিইআরসি গ্যাসের দাম গড়ে বাড়ায় ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ পর্যন্ত। এর এক বছরের মধ্যেই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। প্রস্তাবে দেখা যায় যে, গৃহস্থালি মিটারযুক্ত গ্রাহক শ্রেণির জন্য গ্যাসের দাম প্রতি ঘন মিটারে ৭ টাকা থেকে ১৪০ শতাংশ বাড়িয়ে একবারে ১৬ দশমিক ৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এক বার্নারের মূল্য প্রতি ঘন মিটারে ৬০০ টাকা থেকে ৮৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১ হাজার ১০০ টাকায় ও দুই বার্নারে জন্য প্রতি ঘন মিটারে ৬৫০ টাকা থেকে ৮৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ টাকায় ধার্য করা হয়েছে। অন্যান্য প্রস্তাবে বিদ্যুৎ-ক্যাপটিভের দাম প্রতি ঘন মিটারে ৮ দশমিক ৩৬ টাকা থেকে ১৩০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৯ দশমিক ২৬ টাকায় উন্নীত করা, শিল্পের জন্য বিদ্যুতের দাম প্রতি ঘন মিটারে ৬ দশমিক ৭৪ টাকা থেকে ৬২ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৯৫ টাকায় উন্নীত করা, বাণিজ্যিক (চা বাগানসহ) বিদ্যুতের দাম প্রতি ঘন মিটারে ১১ দশমিক ৩৬ টাকা থেকে ৭২ শতাংশ বাড়িয়ে ১৯ দশমিক ৫০ টাকায় উন্নীত করা, সিএনজি ফিড গ্যাসের দাম ২৭ টাকা থেকে ৮৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৯ দশমিক ৫০ টাকায় উন্নীত করা, বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ব্যবহূত গ্যাসের দাম প্রতি ঘন মিটারে ২ দশমিক ৮২ টাকা থেকে ৬৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৬০ টাকায় উন্নীত করা ও সার কারখানার জন্য বিদ্যুতের দাম প্রতি ঘন মিটারে ২ দশমিক ৫৮ টাকা থেকে ৭১ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৪১ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সিএনজি স্টেশন ও কনভার্শন ওয়ার্কশপে বিনিয়োগকারীরা বেকায়দায় পড়বেন। এ ছাড়া সাধারণ যাত্রীদের পরিবহন ব্যয়ও বাড়বে। বাংলাদেশ সিএনজি স্টেশন অ্যান্ড কনভার্শন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাসুদ খান বলেন, ২০০০ সালে সরকার স্বউদ্যোগে ওয়ানস্টপ সার্ভিস দিয়ে আমাদের সিএনজি স্টেশনে বিনিয়োগে উৎসাহ দিয়েছে। সিএনজির দাম বাড়ানো হলে কেউ আর এটি ব্যবহার করবে না। তখন শহরগুলোতে বায়ু দূষণ বেড়ে যাবে। এতে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের অতিরিক্ত ৩২০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে ৫৯০টি সিএনজি ফিলিং স্টেশন রয়েছে। আরও বিপুল সংখ্যক কনভার্শন ওয়ার্কশপ রয়েছে। প্রায় ছয় লাখ যানবাহন সিএনজি চালিত। প্রতিটি যানবাহন সিএনজিতে কনভার্শন করতে ৬০-৬৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন সিএনজি কেন্দ্রিক সব খাতের বিনিয়োগই মাটি হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সর্বশেষ খবর