শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

যশোরের রাজনীতিতে পালা বদল

সাইফুল ইসলাম, যশোর

যশোরের রাজনীতিতে পালা বদল

কয়েক যুগ ধরেই যশোরের রাজনীতি মানেই তিন বাল্যবন্ধু তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো আর আলী রেজা রাজুকেই বুঝত দেশের মানুষ। ষাটের দশকে অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়ন করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে তাদের হাতেখড়ি। এর পরের কয়েক দশক জুড়ে তারা কখনো ছিলেন একই ছাতার নিচে, কখনো তাদের পথ হয়ে যায় আলাদা। প্রতিপক্ষ হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তিনজনই সংসদ সদস্য হয়েছেন যশোর-৩ (সদর) আসন থেকে। তরিকুল ইসলাম মন্ত্রী হয়েছেন কয়েক দফা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়েছেন এবারও। মন্ত্রী হয়েছেন খালেদুর রহমান টিটোও। তিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিবও হয়েছিলেন। আলী রেজা রাজু একসময় জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন।

দীর্ঘদিন কিডনি রোগে আক্রান্ত থেকে ১৫ জুলাই ঢাকার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন আলী রেজা রাজু। শেষ পর্যন্ত ছিলেন আওয়ামী লীগেই। খালেদুর রহমান টিটো আওয়ামী লীগেই আছেন। তবে পাঁচ-ছয় বছর ধরেই রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় তিনি। আর তরিকুল ইসলাম বিএনপির নতুন স্থায়ী কমিটিতে আবারও জায়গা পেয়েছেন। কিন্তু তিনিও ডায়াবেটিস, কিডনিসহ দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছেন শারীরিক নানা জটিলতায়। আজীবন আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে আসা এই তিন বন্ধুই তাদের জীবনের শেষ দিকে এসে আর তাল মেলাতে পারেননি। কালো টাকা আর পেশিশক্তির দাপটের রাজনীতি শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা নিজেদের গুটিয়ে ফেলতে শুরু করেন। তাদের এই অসহায়ত্বের কথা এর আগে বহুবারই তারা বিভিন্ন স্থানে স্বীকারও করেছেন।

কয়েক বছর ধরেই যশোরের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এই সময়ে যশোর আওয়ামী লীগে সবচেয়ে দাপুটে নেতায় পরিণত হয়েছেন দ্বিতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা শাহীন চাকলাদার। তিনি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান হিসেবেও দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পালন করছেন। তারই কাছের আত্মীয় জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম রেন্টু চাকলাদার হয়েছেন যশোর পৌরসভার মেয়র। তাদের সঙ্গে আছে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ। আর সদর আসনের সংসদ সদস্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী নাবিল আহমেদ। তার সঙ্গেও আছে আওয়ামী লীগের অপর অংশটি। আর বিএনপির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) হয়েছেন তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। তরিকুল ইসলামের ভাইপো মারুফুল ইসলাম যশোর পৌরসভার মেয়র হয়েছিলেন। সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। নগর বিএনপির সভাপতি মারুফুল ইসলাম এবার জেলা বিএনপির সভাপতি হওয়ার দৌড়ে বেশ এগিয়ে আছেন বলে দলের অনেকেই মনে করছেন। যশোরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এসব নেতার হাতেই থাকবে বলে মনে করছেন তারা। দীর্ঘদিন ধরে যশোরের রাজনীতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বিশিষ্ট লেখক-গবেষক বেনজিন খান। তিনি বলেন, তিন বন্ধুর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা, তারা যশোরে প্রজ্ঞাসম্পন্ন রাজনীতি দাঁড় করাতে পারেননি। কিন্তু তারা সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তাও তারা বজায় রেখেছিলেন। এই বাস্তবতা এক ধরনের স্বস্তি উপহার দেয়। কিন্তু এখন প্রজ্ঞাসম্মত রাজনীতি তো নেয়ই, সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্পর্কও এখন ধ্বংস করা হয়েছে। আগে আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনো বিবাদ হলে নেতারা বসে বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলতেন। এখন নালিশ করারও কোনো জায়গা নেই। বেনজিন খান বলেন, ‘এ সমস্যার সমাধান আঞ্চলিকভাবে হবে না। সমাধান আসতে হবে কেন্দ্র থেকে। কিন্তু সেই কেন্দ্রেও আমরা এখন অন্ধকার দেখছি।’ তিনি বলেন, তিন বন্ধু তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো ও আলী রেজা রাজু নিজেদের মধ্যকার বন্ধুত্বের কারণে অনেক কিছু মেনে চলতেন। কিন্তু প্রজ্ঞাসম্পন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তারা দাঁড় করাতে পারেননি। নিয়মিত নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের বিশ্বাস বা দর্শনের আলোকে যদি তারা পাঠচক্র বা শিক্ষা চালু রাখতেন, তাহলে প্রজ্ঞাসম্পন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক রাজনীতি একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেত। কিন্তু তা হয়নি। রাজনীতিতে যখনই জ্ঞানের কদর হয়নি, তখনই সেখানে ক্ষমতা, টাকা, পেশিশক্তিই কদর পেয়ে গেছে। এখানে তা আরও বেশি হয়েছে। এখন এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনীতির বাইরে থাকা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার উৎপাদকশ্রেণির সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাপটা আসতে হবে। এই শ্রেণির মানুষকে ক্রমাগত স্টাডি সার্কেলের মধ্য দিয়ে তার ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে। তাহলে কোনো ভুঁইফোড় নেতা এই শিক্ষিত মানুষদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তখন এই নেতাদের মনে তাগিদ তৈরি হবে যে, তাদের সামনে দাঁড়াতে গেলে ওই মানুষদের চেয়েও নিজেদের বেশি শিক্ষিত হতে হবে।

সর্বশেষ খবর