শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

রংপুরকে ধরে রাখতে শেষ চেষ্টা এরশাদের

শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর

রংপুরকে ধরে রাখতে শেষ চেষ্টা এরশাদের

‘একসময় ছিল বন্যা। এখন হাঁটুপানি। ভবিষ্যতে খরার কবলে পড়বে’— এভাবেই রংপুরে জাতীয় পার্টির অবস্থা তুলে ধরলেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। রংপুরে জাতীয় পার্টিতে যে প্রকৃতই হালে পানি নেই, অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে দলটি, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবি। দুর্গেই আজ দুর্গতি হয়েছে দলটির। তবে দুর্গতি কাটিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে দলটি। রংপুরকে ধরে রাখতে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছেন পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

একসময় রংপুর মানেই ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাতীয় পার্টি এবং লাঙ্গল। ১৯৯০ সালে কারাগারে যাওয়ার পর এরশাদের প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে রংপুরের মানুষ। রংপুরে এরশাদের আগমন মানেই হুলস্থুল ব্যাপার। তিনি ১৯৯৬ সালে কারামুক্ত হয়ে যখন প্রথম রংপুরে আসেন, সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে রংপুর শহরের পথের দুই পাশে আক্ষরিক অর্থেই গায়ে গা লাগিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাকে সংবর্ধনা দিয়েছেন। রংপুর শহরে এমন জনজোয়ার নেমেছিল, যা অদৃশ্যপূর্ব।

সে সময় সাধারণ ভোটারদের কাছে ‘এরশাদ আবেগ’ এতটাই মজবুত হয় যে, প্রার্থীর যোগ্যতা বা অযোগ্যতা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। প্রার্থীর প্রতীক ‘লাঙ্গল’ হলেই হলো। জয় তার সুনিশ্চিত। এ অবস্থায় ‘জাপার দুর্গে’ পরিণত হয় রংপুর। সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেওয়ার পর থেকে দলটিতে ধস নামতে শুরু করে। সেই জনবন্যা এখন কেবল রোমন্থনের মধুর স্মৃতি। এখন এরশাদ এলে সাধারণ মানুষের আবেগে তেমন আলোড়ন ওঠে না। দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্য জাগে। কয়েকশ লোক তাকে সঙ্গ দেন। জেলা ও মহানগর কার্যালয় হয়ে ওঠে সরগরম। তবে গ্রামে জনসভা করলে অবশ্য এখনো ভালো জমায়েত হয়। রংপুরে জাতীয় পার্টি যে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সম্প্রতি শেষ হওয়া পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি। জেলার ৭৬টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রার্থী জিতেছেন মাত্র সাতটিতে। পৌরসভা নির্বাচনে রংপুরের তিনটি পৌরসভার মধ্যে হারাগাছ ও পীরগঞ্জে মেয়র পদে প্রার্থীই দিতে পারেনি দলটি। বদরগঞ্জ পৌরসভায় জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী ১৭১ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে আট উপজেলার একটিতেও দলটির প্রার্থীরা জয় পাননি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন মাত্র একটিতে। এমনকি সদর উপজেলায় স্বয়ং এরশাদ প্রচারে নেমেও কোনো সুবিধা করতে পারেননি। এ ছাড়া ষষ্ঠ থেকে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে রংপুরের ছয়টি আসনেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচিত হলেও নবম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসন চলে যায় আওয়ামী লীগের ঘরে। আর দশম সংসদ নির্বাচনে আসন পান দুটি। প্রথম রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী ২৮ হাজার ভোটে পরাজিত হন। কেন এমন হলো, তা নিয়ে নানাজনের নানা মত। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা কমিটির প্রবীণ সদস্য সৈয়দ নূর আহমেদ মনে করেন, জাতীয় পার্টি স্রোতের বিপরীতে চলছে। দলীয় চেয়ারম্যানের ঘন ঘন সিদ্ধান্তের পরিবর্তন এবং আওয়ামী লীগের লেজুড় হওয়ার কারণে মানুষ জাতীয় পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। রংপুরে একসময় জাতীয় পার্টির জনসমর্থন ছিল বন্যার মতো। এখন হাঁটুপানি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে আগামী দিনে হয়তো দলটি খরার কবলে পড়বে বলে মন্তব্য করেন এই প্রবীণ নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির স্থানীয় কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, সব পরিকল্পনা, সব ভাবনা এককভাবে চেয়ারম্যানের মাথায়। রংপুরের নেতাদের কোণঠাসা করে রেখে সব সিদ্ধান্ত তিনি একাই নেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মতামত না নিয়ে ঢাকায় বসে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় সব নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। বোন শেখ হাসিনার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে গিয়ে দলকে শেষ করেছেন তিনি। আজকে দলের দুরবস্থার জন্য এরশাদই দায়ী, নেতা-কর্মীরা নন। তবে রংপুরে দলের গতি ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি হারানো দুর্গ টিকিয়ে রাখতে এরশাদ উদ্যোগ নিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে জেলা কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি মোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, মহানগর আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা ও যুগ্ম-আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সালাহ উদ্দিন কাদেরীকে কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহানগর জাতীয় পার্টির যুগ্ম-আহ্বায়ক এ কে এম আবদুর রউফ মানিককে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বসিয়েছেন। এতে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছেন। এ ছাড়া চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে রংপুরে সফরে এসে এরশাদ দলীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন। কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা বলেন, বৈঠকে পার্টি চেয়ারম্যান রংপুরকে ফের জাতীয় পার্টির দুর্গে পরিণত করতে দলকে শক্তিশালী এবং নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। দল গোছানোর কাজ শুরু হয়েছে। জাতীয় পার্টিসহ সব সহযোগী সংগঠনে নতুন সদস্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কর্মিসভা করা হচ্ছে। রংপুরে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তায় কোনো ঘাটতি নেই বলে দাবি করে দলটির কো-চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের বলেন, ২০১৪ সালের পর থেকে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি। নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে দলীয় প্রভাবের পাশাপাশি প্রশাসনও সহায়তা করায় কোনো নির্বাচনেই জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। রংপুর জাতীয় পার্টির দুর্গ। এ দুর্গ কেউ ভাঙতে পারবে না। বিভিন্ন কারণে দলের কিছুটা ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে। তবে তা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টির জনসমর্থন ফের বন্যার মতো হবে।

সর্বশেষ খবর