রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কঠোর নিরাপত্তায় গোটা দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

কঠোর নিরাপত্তায় গোটা দেশ

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকরকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কায় গতকাল ভোর থেকেই মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। জামায়াত-শিবিরের নাশকতাসহ উদ্ভূত যে কোনো সহিংস পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাবার বুলেট, এমনকি প্রয়োজনে গুলি ছোড়ারও নির্দেশ রয়েছে। রাজধানীর উপকণ্ঠ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর চারদিকে গড়ে তোলা হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। র‌্যাব, জেলা গোয়েন্দা পুলিশ, দাঙ্গা পুলিশ, বোম ডিসপোজাল ইউনিট মিলিয়ে মোট পাঁচ স্তুরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাশিমপুর কারাগার এলাকা এবং রাজধানীতে মাঠে নেমেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি পয়েন্টে এপিসি, জলকামান ও রায়টকারসহ সব ধরনের রণপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে পুলিশ। স্পর্শকাতর জেলার প্রবেশমুখসহ এসব নগরীর ব্যস্ততম সড়কে বিশেষ চেকপোস্ট বসেছে। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার বিষয়টি মাথায় রেখে আঁটসাঁট নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ জানান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গাজীপুরে চার প্লাটুন বিজিবি সদস্য পাঠানো হয়েছে। তবে দেশের সবকটি ব্যাটালিয়নকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজনে তারা মাঠে নামবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার পর থেকেই রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তারপরও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি রায় ঘোষণা ও বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে কোনো পক্ষই যেন নাশকতার চেষ্টা করতে না পারে এই বিষয়টি মাথায় রেখে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় পুলিশ সদস্য ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া আদালতপাড়ায়ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, মীর কাসেমের রায়কে ঘিরে গতকাল সারা দেশের নিরাপত্তায় প্রায় ৫০ হাজার ফোর্স মাঠে নেমেছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই মোতায়েন রয়েছে প্রায় তিন হাজার র‌্যাবসহ পুলিশের ১১ হাজার সদস্য। পর্যাপ্ত সংখ্যক র‌্যাব-পুলিশসহ গোয়েন্দারা ঘিরে রেখেছেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারগার চত্বরের আশপাশের এলাকা। লাশ নিয়ে যাওয়ার পথেও জেলা পুলিশকে বিশেষ সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, আগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের রায়ের পর চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, মৌলভীবাজার, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, নীলফামারী, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, পাবনা, গাজীপুর ও নোয়াখালীসহ যে ২৬ জেলায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ওইসব এলাকা এবার ঢাকা থাকছে কঠোর নিরাপত্তায়। এ ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থানে যেখানে জামায়াত-শিবিরের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে সেখানেও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে জেলার পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন  মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনের গতিবিধি নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।

গোয়েন্দারা জানান, মীর কাসেম জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। একই সঙ্গে তিনি এই দলটির অন্যতম দাতা। দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের শক্ত ভিত গড়ে তোলার পেছনে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তার রায় বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে নাশকতা চালাতে পারে। এমন আশঙ্কাকে গুরুত্ব দিয়েই নিরাপত্তা ছক সাজানো হয়েছে। মঙ্গলবার মীর কাসেম আলীর রিভিউ আপিল খারিজ হওয়ার পর থেকেই চলে নিরাপত্তা নিশ্চিতের যত আয়োজন। রায় কার্যকরের পর পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ নগরীর বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে পুলিশের চেকপোস্ট। অতিরিক্ত টহলে রাখা হচ্ছে পুলিশ ও র‌্যাবের বিশেষ টিম। প্রস্তুত রাখা হয়েছে এপিবিএন পুলিশ। প্রস্তুত রাখা হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট। এদিকে ডিএমপি সূত্র জানায়, গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর মত্স্য ভবন থেকে শুরু করে প্রেসক্লাব, দোয়েল চত্বর, শিশু একাডেমি এলাকাসহ সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এলাকায় চলাচলরত সাধারণ যাত্রীদের তল্লাশি করা হচ্ছে। শিশু একাডেমির সামনে দিয়ে ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় গেটসহ সংলগ্ন এলাকা, শিক্ষা ভবন, কদম ফোয়ারা, পুরনো হাইকোর্ট ও দোয়েল চত্বরসহ পুরো এলাকায় সক্রিয় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল দুপুরের পর থেকে গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী, সদরঘাট, কমলাপুর, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সাতরাস্তা, মগবাজার, পল্টন, কাকরাইল, শাহবাগ, আরামবাগ, মালিবাগ, শাজাহানপুর, প্রেসক্লাব, বিজয়নগর, বায়তুল মোকাররম উত্তর ও দক্ষিণ গেট, দৈনিক বাংলা মোড়সহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল ভোরে এর কয়েকটি পয়েন্টে এপিসি, জলকামান ও রায়টকারসহ পুলিশের বিশেষ গাড়ি টহলে যোগ দেয়। সম্প্রতি সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বলা হয়েছে, জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবি ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা করেছে। পুলিশের গাড়িতে আগুন, ভাঙচুরসহ জনগণের জানমাল বিনষ্ট করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব ও পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন জেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়টি নিশ্চিত করে একাধিক পুলিশ সুপার জানান, সদর দফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে কার ও ফুটপেট্রল। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি ও চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করা হয়েছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কোনো পক্ষই যেন নাশকতা ঘটাতে না পারে সে জন্য সারা দেশে কঠোর নিরাপত্তার ছক সাজানো হয়েছে। র‌্যাব সদস্যরা জনগণের জানমাল রক্ষা ও হেফাজতের জন্য প্রস্তুত। জামায়াত-শিবির বা অন্য কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নাশকতার চেষ্টা চালালে তা কঠোর হাতে দমন করবে। এ জন্য সারা দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক র‌্যাব সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।

সর্বশেষ খবর