রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সিলেটের রাজনীতিতে নানারূপ

স্থবির আওয়ামী লীগ, মামলায়বন্দী বিএনপি, নেতৃত্ব দ্বন্দ্বে জাপা

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

সিলেটের রাজনীতিতে নানারূপ

সিলেটে দেশের সবচেয়ে পুরনো ও অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে দীর্ঘদিন বিরাজ করছিল স্থবিরতা। সিলেটের রাজপথে কোথাও দলটির নেতাকর্মীদের দেখা মিলছিল না। ড্রয়িংরুমে আবদ্ধ রাজনীতি এবং সরকারে বিলীন হয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন সিলেট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তবে দলটির কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের পর সিলেটে সক্রিয় হয়ে উঠছে সাংগঠনিক তত্পরতা। মাঠের রাজনীতিতে ফিরতে শুরু করেছেন শীর্ষ নেতারা। এর ফলে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যেও দেখা দিচ্ছে প্রাণচাঞ্চল্য। গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দুই-তিন মাস বিএনপির আন্দোলন প্রতিহত করার লক্ষ্যে সিলেটের রাজপথের দখল নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। দলটির  নেতাকর্মীদের পদভারে মুখর ছিল সিলেটের রাজপথ। মিছিল, সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনে সক্রিয় ছিল সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপির আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার  পর আওয়ামী লীগও হয়ে পড়ে ঘরমুখী। দলটির নেতা-কর্মীরা রাজপথ ছেড়ে ঘরোয়া কর্মসূচিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে সিলেটে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম হয়ে পড়ে শীর্ষ নেতাদের ড্রয়িংরুমে। সরকারে মিশে যায় সিলেট আওয়ামী লীগ। অভিযোগ ওঠে, দলটির নেতাকর্মীরা রাজনীতির চেয়ে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঠিকাদারি নিয়ে বেশি ব্যস্ত।

গত ইউপি ও পৌর নির্বাচনের সময় ড্রয়িংরুম থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি মাঠে ফিরতে শুরু করে। তবে স্থানীয় সেই নির্বাচন শেষ হতেই আবারও স্থবির হয়ে পড়ে সিলেট আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম। আবারও সেই ড্রয়িংরুম বন্দী রাজনীতির বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে দলটি। তবে দীর্ঘ সময় পর সিলেটে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগ। দলটির সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে উৎসবের আমেজ এসেছিল, সম্মেলন শেষেও তা ধরে রেখেছেন শীর্ষ নেতারা। বৃহত্তর সিলেট আওয়ামী লীগের সাত নেতা কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ায় নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে সিলেট জেলা থেকে আবুল মাল আবদুল মুহিত, অ্যাডভোকেট সৈয়দ আবু নছর, নুরুল ইসলাম নাহিদ, মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও বদর উদ্দিন আহমদ কামরান কেন্দ্রে পদ পাওয়ায় সিলেট আওয়ামী লীগে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। সিলেট আওয়ামী লীগের অন্যতম চালিকাশক্তি এই পাঁচ নেতার পদপ্রাপ্তিতে গতিশীল হতে শুরু করেছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী বুধবার সিলেটে বিশাল সমাবেশ করতে যাচ্ছে দলটি। যেখানে দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বক্তব্য রাখবেন। এ সমাবেশকে ঘিরে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এখন উত্ফুল্ল ভাব। সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও রয়েছেন দৌড়ঝাঁপের মধ্যে।

এ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে বড় দল। সিলেটে আওয়ামী লীগ খুবই শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকায় সিলেটে নেতাকর্মীরা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও তা ছিল সাময়িক। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে ব্যাপক তত্পর। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সংগঠিত। তৃণমূল পর্যায় থেকে সংগঠনকে শক্তিশালী করার কাজ চলছে। তবে দল ক্ষমতায় স্বাভাবিকভাবেই সংগঠনে কিছুটা স্থবিরতা আসে। কিন্তু দেশের প্রয়োজনে যখনই প্রয়োজন হয়েছে, যেমন বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও, নৈরাজ্য প্রতিহত করতে ঠিকই রাজপথে ছিল সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ।

মামলার জালে বন্দী বিএনপির রাজনীতি : রাজপথে নেই কোনো কর্মসূচি, সম্মেলনের এগারো মাস পরও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি, মামলার জালে বন্দী সহস্র নেতাকর্মী— এ রকম অবস্থায় সিলেট বিএনপি দিশাহারা অবস্থার মধ্যে রয়েছে। সিলেটে দলটির জেলা ও মহানগর শাখাতে নেই তেমন সাংগঠনিক তত্পরতা। মাঝে মধ্যে ঘরোয়া আসরেই বন্দী তাদের কার্যক্রম। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথে নেমেছিল বিএনপি। সিলেটেও দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ছিল চাঙ্গাভাব। কিন্তু আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করতে গিয়ে মুখথুবড়ে পড়ে বিএনপি। সিলেটে দলটির সহস্র নেতাকর্মীকে জড়াতে হয় অসংখ্য মামলার জালে। সেই মামলার জাল ছিঁড়ে এখনো বের হতে পারেননি তারা। উপরন্তু নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে পড়ায় জাতীয় পর্যায়ে বিএনপি যেভাবে স্থবির হয়ে পড়ে, তেমনি সিলেটেও দলটির কার্যক্রমে দেখা দেয় নিষ্ক্রিয়তা। সর্বশেষ পৌর ও ইউপি নির্বাচনে সিলেটে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে সরব হয়েছিলেন। তৃণমূলেও লেগেছিল সেই সরব হওয়ার ঢেউ। কিন্তু কেন্দ্র থেকে রাজপথের কর্মসূচি না থাকায় নেতা-কর্মীদের সেই প্রাণচাঞ্চল্য ধরে রাখতে পারেননি দলের নেতারা। ফলে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে সিলেট বিএনপির রাজনীতি।

শনিবার নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে খন্দকার মালিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘শহীদ জিয়া স্মরণে আলোচনা সভা’র আয়োজন করা হয়। ওই সভায় প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল দলের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলীয় কাজের জন্য ঢাকা থেকে সিলেটে আসতে না পারায় তিনি ঢাকা থেকে টেলিকনফারেন্সে বক্তব্য রেখেছেন। মির্জা ফখরুলের অনুপস্থিতিতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। ওই সভায় দলের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের সরব উপস্থিতি সিলেটের শীর্ষ নেতাদের কিছুটা হলেও আশান্বিত করেছে। তৃণমূলের উজ্জীবিত এই শক্তিকে কাজে লাগানো গেলে রাজপথে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলা সম্ভব বলেও মনে করছেন দলটির নেতারা। এদিকে, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে জেলা ও মহানগর শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে সময় দ্রুততার সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন নবনির্বাচিত নেতারা। কিন্তু সম্মেলনের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ১০ মাস। এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটির মুখ দেখেননি সাধারণ নেতা-কর্মীরা। ফলে শেষ হচ্ছে না তাদের প্রতীক্ষাও। এ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের শামীম বলেন, ‘আমরা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে কেন্দ্রীয় সব কর্মসূচিই সিলেটে সফলভাবে সম্পন্ন করেছি। একইসঙ্গে দলকে সংগঠিত করা ও নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করে তোলার কাজও করছি আমরা। চলতি মাসের মধ্যেই সিলেট জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার কাজ চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে মুক্ত হতে বিএনপির যে আন্দোলন, সে আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে সিলেট জেলা বিএনপি সবসময়ই সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।’

দ্বন্দ্বে জর্জর জাপা, ভালো নেই বাম-জামায়াত : এক সময় জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল সিলেট। সেই দুর্গ এখন বিধ্বস্ত প্রায়। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও কোন্দলে দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সিলেটের কর্মী-সমর্থকরা। ভালো অবস্থায় নেই বামধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও। মাঝে মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোটবদ্ধ কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায় ১৪ দলের শরিকদের। আর জোটের বাইরে থাকা দলগুলোর কর্মসূচি সীমাবদ্ধ ইস্যুভিত্তিক মিছিল-সমাবেশে। অন্যদিকে সিলেটের কোথাও এখন দেখা মেলে না জামায়াতের। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পরও সিলেটে এরশাদ ও জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সারাদেশে ভরাডুবি হলেও সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে ৮টিতে জয়লাভ করেছিল জাতীয় পার্টি। কিন্তু নেতাদের  স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি সংগঠনটি। পরবর্তীতে জাপার সাংসদ ও নেতাদের দলবদলে দুর্বল হয়ে পড়ে সংগঠনের কার্যক্রম। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারায় সংগঠনটি। সিলেটে এখনো নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রকট এবং মাঠপর্যায়ে দলটির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বর্তমানে সিলেটে পাঁচটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চলছে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম। নেতানির্ভর এই গ্রুপগুলো রাজপথ ছেড়ে বন্দী হয়ে আছে ড্রয়িংরুমে। তবে অতীত শক্তি ও জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে বর্তমানে ব্যাপক সাংগঠনিক তত্পরতা চলছে বলে দাবি জাতীয় পার্টির নেতাদের। দলটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা প্রসঙ্গে সিলেট মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ইয়াহইয়া চৌধুরী এমপি বলেন, ‘গত মাসে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের সিলেট সফরে নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। দীর্ঘদিন পর মহানগর শাখার কমিটি গঠন করা হয়েছে। অঙ্গ সংগঠনগুলোর কমিটিও হচ্ছে। সবমিলিয়ে জাতীয় পার্টি আগের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে কাজ চলছে।’ এদিকে সিলেটে বর্তমানে বাম সংগঠনগুলোর অবস্থা ভালো নেই। সরকারের জোটবদ্ধ বাম সংগঠনগুলোর বেশিরভাগের কার্যক্রম জোটের কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ। তবে সিলেটের রাজপথে দেখা মিলে না এসব দলের নেতাকর্মীদের। হঠাৎ হঠাৎ ঘরোয়াভাবে আলোচনা সভাতেই বন্দী তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম। সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ ১৪ দলের শরিক বাম সংগঠনের নেতারা মনে করেন, বামদলগুলো দুর্বল হয়ে পড়ার পেছনে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, অনৈক্য ও ষড়যন্ত্রই প্রধান কারণ। অন্যদিকে এ জোটের বাইরে থাকা বাম দলগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। কর্মীহীন হয়ে কয়েকজন নেতানির্ভর দল হিসেবে সংগঠনগুলো টিকে আছে।

সর্বশেষ খবর